বলির পাঁঠা ‘সুইসাইড থিওরি’ এ যুগে অচল
ভারতের এয়ারক্রাফট এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো সম্প্রতি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনার ১৫ পাতার যে সরকারি প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা নিজ দেশে প্রকাশ হওয়ার আগেই বোয়িং এবং ইঞ্জিন কোম্পানিকে তারা ক্লিন চিট (ছাড়পত্র) দিয়ে দিয়েছে। সেইসঙ্গে আমেরিকার সংবাদপত্র ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালে রিপোর্টের গোপনীয় তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে।
রিপোর্টের ১৫ পাতার এক অংশে মূলত পাইলটের ব্যর্থতার কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে। সম্পূর্ণ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করার আগেই ইউরোপ এবং আমেরিকার পত্রিকাগুলোতে পাইলটদের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে হিউমিলিয়েট করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— সম্পূর্ণ তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এবং প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কেন এই আত্মঘাতী অপবাদ?
বিজ্ঞাপন
এটি যদি শুধু ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির কথা হিসাব করে কৌশল হয়ে থাকে, তাহলে এই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়— যাত্রীদের জীবনই যদি অনিরাপদ হয়, তবে যাত্রীসেবা করে এয়ারলাইন্সের লাভ তো দূরের কথা, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে এবং সঠিক তদন্ত না হলে এরকম ঘটনা পরবর্তীতে আবার ঘটতে পারে। যা মেনে নেওয়া ভীষণ কঠিন।
যদিও প্রাথমিক রিপোর্টের ফাইন্ডিংস হিসেবে ককপিটে কর্তব্যরত দুই পাইলটের একটি ‘খণ্ডিত আংশিক’ কথোপকথনের অংশের কথা জানা গেছে। যেখানে একজন অপরজনকে বলেছেন, ‘আপনি সুইচ বন্ধ করেছেন কেন?’ এর উত্তরে অন্যজন বলছেন, ‘আমি এটি করিনি।’ শুধু এটুকুই জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
তবে এই কথোপকথনে কোন পাইলট প্রশ্নকর্তা এবং কোন পাইলট উত্তরদাতা, প্রতিবেদনে তা কিন্তু বলা হয়নি। তা ছাড়া, এই কথোপকথনের আগে ও পরে কী কথা আছে তাও জানা যায়নি। তবে এতটুকু স্পষ্ট যে এই সর্বনাশের কারণ হচ্ছে উভয় ইঞ্জিন ফেইলিওর। যা বিরল ঘটনা হলেও এর কারণ হচ্ছে ডাবল ‘ফুয়েল কাট অফ সুইচ’ অফ হয়ে যাওয়া।
এই ডাবল ইঞ্জিন ফেইলিওরের কারণ সিনিয়র পাইলট নাকি জুনিয়র পাইলট নাকি উভয়েই, নাকি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হিউম্যান ইন্টারফেয়ারেন্স, নাকি ম্যানুফ্যাকচারিং এরর, নাকি ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার ফেইলিওর অথবা সফটওয়ার গ্লিচ— এসব নিয়ে দফায় দফায় দেশে-বিদেশে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। যেখানে দেশি-বিদেশি পত্রিকা এবং গণমাধ্যমে অনেকেই পাইলটের দিকে আঙুল তুলতে স্বাচ্ছন্দ্য ও আগ্রহ বোধ করছেন বলেই মনে হচ্ছে।
আরও পড়ুন
শুধু তাই নয়, এভিডেন্স ছাড়া অনেকেই পাইলটের মেন্টাল হেলথ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলটের কথাও অনেকে টেনে এনেছেন, যে বিষয়টি এখনো সমাধান হয়নি। মৃত ব্যক্তিকে বলির পাঁঠা করে হয়তো দায় এড়ানো যায় এবং একই সঙ্গে অন্যান্যদেরকেও নির্দোষ প্রমাণিত করা যায়। কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠা করে নিরাপদ যাত্রীসেবার আস্থা প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ বিষয় নয়। সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক লাভ-ক্ষতির হিসেবের খাতা সাময়িকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন মনে হলেও অদূর ভবিষ্যতে নির্মম সত্যকেই সবাই মেনে নিতে চাইবে। অন্যথায় আস্থা হারালে শেষ পর্যন্ত যাত্রীসেবা ক্ষতির মুখে পরবে।
ম্যানুয়ালি সুইচ অফের জন্য পাইলট দায়ী কি দায়ী নয়— এই তুমুল বিতর্কের মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলক দিলো যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) ২০১৮ সালের একটি বুলেটিন। যেখানে অন্য কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এফএএ একটি স্পেশাল এয়ারওয়ার্দিনেস বুলেটিন জারি করে। যেখানে জানানো হয়েছিল— বোয়িংয়ের এয়ারক্রাফট ফুয়েল সুইচ লকিং ফিচার বিচ্ছিন্নভাবে ইন্সটল করা হয়েছে। বিষয়টি ফুয়েল কন্ট্রোল লকিং সুইচ ডিজএঙ্গেজড (বিচ্ছিন্ন) বিষয়ক। যেখানে জানানো হয়েছে, ওনারস অ্যান্ড অপারেটরসদের এই এয়ারক্রাফটে যদি লকিং ফিচার্স ডিজএঙ্গেজড হয়, তাহলে ফুয়েল সুইচ অন পজিশন থেকে অফ পজিশন হিউম্যান ইন্টারফেয়ার ছাড়াও হতে পারে।
এখানে এই ফুয়েল সুইচের ত্রুটির কথাই জানানো হয়েছে। কারণ, এই সুইচগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবে আপনা-আপনি সরে যেতে পারে। অর্থাৎ ফুয়েল কন্ট্রোল কাট অফ সুইচের লকিং মেকানিজমের সমস্যার কথাই ২০১৮ সালের এই বুলেটিনে জানানো হয়েছিল। যদিও এই বুলেটিনে এয়ারলাইন্সগুলোকে বিষয়টিকে সেইফটি ইস্যু হিসেবে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়নি। তখন যদি বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হতো, তাহলে এয়ারলাইন্সগুলো হয়তো আরো সতর্ক হতো। এতোগুলো জীবননাশ নাও হতে পারতো। যেহেতু ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটি এ কথা সাত বছর আগেই জানিয়েছে, তাই সম্পূর্ণ বিষয়টি প্রমাণের আগে পাইলটদের দোষ দেওয়া যায় না।
এ ছাড়া, নোটিশ অব ইউকে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটি পোটেনশিয়াল কনসার্ন অব ফুয়েল শাট অব সুইচ, বোয়িং ৭৩৭, ৭৫৭, ৭৬৭, ৭৮৭ এবং ৭৭৭- সবগুলো এয়ারক্রাফট মডেলের এই সুইচ নিয়ে সাবধানতার কথা বলেছিল ঠিক এই বছরের (২০২৫ সাল) ১৫ মে। একই সঙ্গে এই এয়ারক্রাফটগুলোর ফুয়েল শাট অব সুইচ পরীক্ষা এবং রেগুলার চেক করার কথা বলা হয়েছে, যা এয়ার ইন্ডিয়া ফলো করেনি। এমনকি এই দুর্ঘটনার প্রাথমিক রিপোর্ট প্রস্তুতে এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট এসোসিয়েশনের কোনো প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি। শুধু তাই নয়, এই দুর্ঘটনার কোনোকিছুতেই পাইলট অ্যাসোসিয়েশনকে ডাকা হয়নি।
আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে— এভিয়েশন সেক্টরে যাদেরকে পাইলটদের সহযোগী বন্ধু বলা হয়, তারা হচ্ছেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। যারা পাইলট এবং কো-পাইলটের সঙ্গে একসঙ্গে একটি ফ্লাইটের টেক অফ এবং ল্যান্ডিং ইভেন্ট পরিচালনা করেন। তাদের কাছে এয়ারক্রাফট মুভমেন্টের প্রতিটি সেকেন্ড রেকর্ডেড থাকে। তাদেরকেও এই দুর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাদের কাছেই তো সমস্ত কথোপকথন থাকার কথা। কারণ, তারা প্রতিটি টেক অফ এবং ল্যান্ডিং মনিটরিংয়ের সাক্ষী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই দিনের ওই সময়ের দায়িত্বরত এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার কোথায় হারালেন?
শুধু ককপিট ভয়েস রেকর্ডার নয়, প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। ওই ফ্লাইটের টেক অফের সময় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের সঙ্গে পাইলটদের কী কথা হয়েছে, তার সমস্ত বিবরণ কর্তব্যরত এটিসি অফিসারের কাছে থাকার কথা। যেহেতু ঘটনাটি ঘটেছে টেক অফের সময়ে, যেখানে ক্যাপ্টেন, কো-পাইলট আর এটিসির কর্মী একটি টিম ওয়ার্ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সেখানে অবশ্যই এই তিন পক্ষ ওই সময়টিতে একে অপরের নজরবন্দি ছিলেন। যেখানে সবাই সবাইকে দেখেছে শুনেছে এবং কমিউনিকেট করেছে। তাই টেকনোলজির এই অভাবনীয় সাফল্যের যুগে সঠিক তথ্য নিয়ে সংশয়; এটি মেনে নেওয়া অসাধ্য। বিষয়টি এমন নয় যে টেক অফের সময় কো-পাইলট সাময়িকভাবে অজ্ঞান ছিলেন বা এটিসি অজ্ঞান ছিলেন, এই ফাঁকে আত্মহত্যাপ্রবণ পাইলট মোক্ষম সুযোগটি পেয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন।
রেকর্ডেড তথ্য থেকে জানা গেছে, মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটি ইঞ্জিনের ‘ফুয়েল কাট অফ সুইচ’ অফ করা হয়েছে। বিস্ময়কর বিষয়টি শুধু একটি সুইচের ক্ষেত্রে ঘটেনি। হতবাক এবং মর্মান্তিক ঘটনাটি দুটি ইঞ্জিন সুইচের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। তা-ও আবার চোখের পলক পরার চেয়ে কম সময় মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে ঘটেছে।
মূলত, ইঞ্জিনের এই সুইচগুলো যেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই সুইচ অসতর্কভাবে যেন অপারেট করা না হয়ে যায় তাই এই সুইচগুলো গারডেড (সুরক্ষিত) অবস্থায় থাকে। তা ছাড়া, এই সুইচগুলো অপারেট করার জন্য একটি প্রসিডিওর (পদ্ধতি) ফলো করা হয়ে থাকে। যা আপনি লুকিয়ে বা হঠাৎ করে ধাক্কা মেরে উপরে-নীচে করে এটি কখনোই অপারেট করতে পারবেন না। আর এই সুইচ প্যানেলের দুটো অবস্থান থাকে। একটি রান অর্থাৎ ইঞ্জিন চলমান এবং অপরটি কাট অফ মানে, এর মানে ইঞ্জিন বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। এককথায় জ্বালানি সাপ্লাই বন্ধ।
যাই হোক, এই সুইচ অপারেট করার জন্য দুটি আঙুল প্রয়োজন হয়। কারণ, গারডেড সুইচটি ওই অবস্থা থেকে আঙ্গুল দিয়ে গর্তের ভেতর থেকে সামনের দিকে পুল করে অর্থাৎ রিলিজ করে টেনে অন থেকে অফ অবস্থানে নিতে হয়। যদি ধরে নেই এই ঘটনা পাইলট ইন কমান্ড ঘটিয়েছেন, তাহলে তিনি তার দুটি আঙ্গুল প্রথম ইঞ্জিনের সুইচ রান অবস্থান থেকে রিলিজ করে টেনে কাট অফ অবস্থানে নিয়েছেন এবং এর পরপরই এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দ্বিতীয় ইঞ্জিনের আরেকটি সুইচ প্যানেল থেকে দুই আঙ্গুল ব্যবহার করে সুইচটি আন-রিলিজ করে টেনে কাট অফ পজিশনে নিয়ে গিয়েছেন। এখানে আমি আবারো বলছি— এ দুটি কাজের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিলো মাত্র এক সেকেন্ড। যা ভাবতে গেলেই কিন্তু গা শিউরে ওঠে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে তিনি দুই হাত ব্যবহার করে দুটি সুইচ টেনে বের করে অফ সিচুয়েশনে টেনে নিয়ে এসেছেন। যা বাস্তবিকভাবে মানুষের পক্ষে সম্ভব মনে না হলেও মেশিনের পক্ষে যে সম্ভব, তাই বলেই ধারণা করা যায়। কারণ, একটি ফুয়েল কাট অফ সুইচ লকিং অবস্থানের নিকট থেকে টেনে বের করে এনে অফ ম্যানুভারে নিতেই দুই সেকেন্ডের বেশি সময় লাগার কথা।
ধরুন, পাইলট যদি মাঝখানে এক সেকেন্ডের মধ্যে অফ করেই থাকেন তাহলে তাকে দুই হাত একসঙ্গে করে করতে হয়েছে। যদি তাই হয়, তবে টেক অফের সময় সঙ্গে থাকা পাইলট বা কো-পাইলট অবশ্যই সেটি দেখে থাকবেন। যেহেতু একটি সুইচ অফ করতে দুই সেকেন্ডের মতো সময় লাগার কথা, সেহেতু দুটি সুইচ এক সেকেন্ডের ব্যবধানে যে করা সম্ভব নয়, সেটি সিমুলেশন বা মহড়া করেই প্রমাণ করা যেতে পারে।
রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, উড়ানের তিন সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানের দুটি ইঞ্জিনের জ্বালানি সুইচ এক সেকেন্ডের ব্যবধানে চালু ( রান ) অবস্থা থেকে (কাট অফ) বন্ধ অবস্থায় চলে যায়। এই দুই অবস্থানের মধ্যে একটি মধ্যবর্তী অ্যাকশন প্রয়োজন। সেই অ্যাকশনটি হচ্ছে একটি ম্যান্যুভারিং, যা এক অবস্থান বা সিচুয়েশন থেকে অন্য অবস্থান বা সিচুয়েশনে নিতে হয়। এই সাধারণ বিষয়টি বোঝার জন্য এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে।
ড্রাইভ করার সময় আমরা যখন সাধারণ রাস্তা থেকে হাইওয়েতে মারজ করার প্রস্তুতি নেই, তখন হাইওয়ের গাড়ির স্পিডের সঙ্গে নিজেকে ম্যাচ করতে ওই স্পিডে কিছুক্ষণ রান করতে হয়। উড়োজাহাজ মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ান দেওয়ার সময় ওই অবস্থাটি চলতে থাকে। ওই সময়ে ড্রাইভারদের অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখেই কাজটি করতে হয়। তাই ওই সময়টুকু ভীষণ সেন্সেশনাল একটি সময়। এ অবস্থায় আপনার গাড়িতে আপনার চারজন সদস্য সঙ্গে যাত্রী হিসেবে আছেন। সেই টেম্পটেড অবস্থার মধ্যে আপনি কি আপনার গাড়ির সুইচ অফ করে দেবেন? মানে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দেবেন? আত্মহত্যাপ্রবণ পাইলটের কি আত্মহত্যা করার আর কোনো উপায় ছিলো না?
তা ছাড়া, পাইলট ও কো-পাইলট দুজনেই দুজনার অবজারভার, একজন যা করছেন অন্যজন তা মনিটরিং করছেন। এমন নয় যে একজন যা করছেন অন্যজন তখন চোখ বন্ধ করেছিলেন বা ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম ভেঙে তিনি দেখলেন দুটি সুইচ অফ হয়ে গেছে, প্লেন নিচে নেমে যাচ্ছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন— কে সুইচ অফ করেছে? তখন অন্যজন উত্তর দিচ্ছেন, আমি করিনি! এ রকম কন্সিকুয়েন্স (পরিণতি) এভিয়েশন বিষয়ে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যদি ধরা যায় পাইলট ইন কমান্ডই এই কাজটি করেছেন, তাহলে এই অ্যাকশনে হতবাক হয়ে কো-পাইলটের শোরগোল করার কথা। চিৎকার করে বলার কথা— এসব কী করছেন আপনি? যেই শোরগোলের কথা ককপিট ভয়েজ রেকর্ডার এবং এটিসির কাছে রেকর্ডেড থাকার কথা। এখানে একজন অ্যাকশন করছেন আর আরেকজন চোখের সামনে তা দেখছেন; না এ রকম হওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। মানে যুক্তিযুক্ত নয়।
দুঃখজনক এবং হতবাক করা ব্যাপার হচ্ছে— এই দুর্ঘটনার দায় কোনোভাবেই যেন ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানির না হয় সেটির জন্য ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী বোয়িং এবং ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচারার জিইকে তারা ইতোমধ্যে ক্লিন চিট দিয়ে অব্যাহতি দিয়েছেন। তাদের কাছে কষ্ট করে তদন্তপূর্বক প্রকৃত কারণ বের করার চেয়ে খুব সহজ হচ্ছে— ব্যবসায়িক চামড়া বাঁচানো। তবে লাভজনক সমাধান হচ্ছে পাইলটের সুইসাইড থিওরি প্রতিষ্ঠিত করা। তাদেরকে বলির পাঁঠা বানানো যেন উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো কৌশল অবলম্বন করা। এতে তাদের জন্য উভয় দিক রক্ষা হয় বলেই তারা মনে করছেন। কারণ মৃত পাইলটতো আর জীবিত হয়ে প্রতিবাদ করতে আসবেন না।
এভিয়েশন জগতের এই বিপদ কখনো কোন দেশের একার স্বার্থ নয়। এখানে সারা বিশ্বের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। এ ঘটনায় পাইলট এবং কেবিন ক্রু এবং যাত্রী; যাদের স্বজন হারানো গেছে তারাই জানে এই বেদনা নিয়েই হয়তো পৃথিবী থেকে তাদের বিদায় নিতে হবে। তাই যার দোষেই হোক প্রকৃত সত্য ধামাচাপা দিলে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং যথার্থ প্রমাণ ছাড়া পাইলটকে বলির পাঁঠা বানানো এক জঘন্য অপরাধ যা এই টেকনোলজির যুগে ভীষণ অচল। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে হয়তো মানিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়, আস্থা অর্জন করা যায় না। যা জঘন্য অপরাধ। যে অপরাধ মেনে নিলে আমি, আপনি বা আপনার কাছের কেউ ভুক্তভোগী হতে পারে। তাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মানুষ হিসেবে আমাদের দায়।
লেখক- সাবিনা শারমিন
সাবেক ব্যবস্থাপক (প্রশিক্ষণ), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড