বাজেট শুধু এক বছরের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনাই নয়, এটা সরকারের রাষ্ট্র পরিচলানার দর্শনও প্রকাশ করে। কোন খাত বেশি গুরুত্ব পাবে আবার কোন খাত কম গুরুত্ব পাবে তাও প্রকাশ পায় বাজেটের মাধ্যমে। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে যারা চিন্তা করেন তারা আশা করেছিল যে করোনাকালের নতুন চ্যালেঞ্জ ও স্বাস্থ্য খাতের পুরনো সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে একটা চমকপ্রদ বাজেট উপহার দেওয়া হবে। কিন্তু হলো পর্বতের মূষিক প্রসব, অন্তত পক্ষে স্বাস্থ্য খাতের বেলায় একথা প্রযোজ্য।

দেশের ৫০তম বাজেটটি হতে পারতো স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের একটা উদাহরণ। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাত মোট বরাদ্দের পাশাপাশি স্থান করে নিবে অতি গুরুত্বপূর্ণ খাতের তালিকায়। কিন্তু ঘটলো ঠিক তার উল্টো।

এই বাজেট ব্যবসাবান্ধব কি না সেটা নিয়ে কথা থাকলেও এটা যে ব্যবসায়ীবান্ধব সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া এই বাজেটের অনেক ভালো দিকও রয়েছে। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আরও দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের নিয়ে আসা, দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করা, বিভিন্নখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি উৎসাহী করা ইত্যাদি।

গত বছরের তুলনায় শুধু টাকার অঙ্কে কিছুটা বাড়লেও এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে তেমন নতুন ও পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। স্বাস্থ্য খাতের জন্য এটা শুধু গতানুগতিকই হয়নি বরং এটা খুবই হতাশাজনক।

বিশেষত এবার একটা বিশাল ও দেশের সর্বোচ্চ বাজেট হওয়া সত্ত্বেও এ বাজেটের ভালো দিকগুলো চাপা পড়ে গেছে মূলত কিছু খাতে বাজেটের অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কারণে। তাতে সেসব খাতের প্রতি অবহেলা দৃশ্যমান হয়েছে। আর সেই তালিকায় স্বাস্থ্য খাতই যে প্রধান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত বছরের তুলনায় শুধু টাকার অঙ্কে কিছুটা বাড়লেও এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে তেমন নতুন ও পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। স্বাস্থ্য খাতের জন্য এটা শুধু গতানুগতিকই হয়নি বরং এটা খুবই হতাশাজনক।

গত বছর যেহেতু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পরে তেমন সময় পাওয়া যায়নি, তাই অনেকে মনে করেছিল এইবার হয়তো আবার একটা গতানুগতিক বাজেট হবে না।

একদিকে বাজেট কম, অন্যদিকে যা বরাদ্দ করা হয় তাও ঠিকমতো খরচ হয় না। আর যা খরচ হয় তাতে কতটা স্বাস্থ্য খাতের কাজে লাগেও সেটাও প্রশ্ন। দুর্নীতির উইপোকারাতো অনেক কিছুই খেয়ে ফেলে।

স্বাস্থ্য খাতে যা বরাদ্দ হয় তার মধ্যে বেতন-ভাতা ছাড়া যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা উপকরণসহ কিছু উপখাতে ভালো ব্যয় হয়ে থাকে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসেছে যে, এইসব খাতে দুর্নীতিও ব্যাপক হয়ে থাকে।

অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা, ন্যায্য মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে কেনা, জিনিস সরবরাহ না করেই বিল উঠিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তাই ব্যবহৃত অর্থের কতটুকু আসলে যাদের জন্য এতো আয়োজন, সে জনগণইবা কতটুকু পায়, সে সন্দেহ রয়েই গেছে। অনেকে বলে থাকেন, যেহেতু ঠিকমতো ব্যয় করতে পারে না, তাই শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ হবে না। এটা পুরোপুরি সত্য নয়।

একদিকে অদক্ষতার কারণে কিছু ব্যয় করতে না পারা, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও দুর্নীতি চলমান। এই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা কমাতে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার অত্যাবশ্যক কিন্তু সেরকম কোনো সুচিন্তার প্রতিফলন এই বাজেটে দেখা যায় না।

দেশে এখনো শুধু স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় মেটাতে গিয়ে ৫০-৬০ শতাংশ লোক দরিদ্র হয়। এটা প্রমাণ করে যে সরকারের আরও অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু সে লক্ষ্যে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না, যা করলে মানুষের কষ্টও লাঘব হতো অন্যদিকে বাজেটে খরচের একটি নতুন খাত পেত।

অন্যদিকে যে অব্যবস্থাপনার কারণে এই অপ্রতুল বাজেটও খরচ হচ্ছে না তা কমাতে উদ্যোগও দেখা যায় না। একদিকে অদক্ষতার কারণে কিছু ব্যয় করতে না পারা, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও দুর্নীতি চলমান। এই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা কমাতে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার অত্যাবশ্যক কিন্তু সেরকম কোনো সুচিন্তার প্রতিফলন এই বাজেটে দেখা যায় না।

শুধু করোনার জন্যই নয়, স্বাস্থ্য খাত শিরোনাম হয়েছে দেশি-বিদেশি সংবাদে। তার যতটা না ভালো নিউজ তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিল দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে।

তাছাড়া স্বাস্থ্য খাতের পুরনো দুর্বলতা ও ক্রনিক ডিজিজ (দুর্নীতি) তার চরম উপসর্গ নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রত্যাশা ছিল এর লাগাম ধরার যার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের আভাস থাকবে। দুঃখজনক হলেও তা হলো না।

প্রবৃদ্ধির বাগাড়ম্বরপূর্ণ মেগা-প্রজেক্টের মেগা বাজেট স্বাস্থ্য খাতের জন্য মেগা দুর্দশার আভাসই দিয়ে গেল।

ড. শাফিউন নাহিন শিমুল ।। সহযোগী অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়