পদে পদে মৃত্যুঝুঁকি
সাংবাদিকতা সরল-সোজা, ঝুঁকিহীন, নির্ঝঞ্ঝাট কোনো পেশা নয়। একজন সংবাদকর্মীর কাজ সমাজের অপরাধ, অসঙ্গতি, অনাচার, মিথ্যাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরে ভিকটিম বা ক্ষতির শিকার নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা। এই কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত একজন সংবাদকর্মীকে ক্ষমতাশালী ব্যক্তির (Powerful Players) বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়।
কখনো এই ব্যক্তি হন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপ্রধান, প্রতাপশালী রাজনৈতিক নেতা, বিত্তশালী ব্যবসায়ী, মাদক চোরাকারবারি, যুদ্ধবাজ নেতা বা ইসরায়েলের মতো খুনপিপাসী কোনো রাষ্ট্র কাঠামো। যাদের সহজ শিকার যুদ্ধাঞ্চলের মানবাধিকার ও মূল্যবোধের কাণ্ডারি একজন সাংবাদিক বা তার সহযোগী সংবাদকর্মী।
বিজ্ঞাপন
যে কারণে সংঘাত কবলিত এলাকায় সাংবাদিকরা অনেক ক্ষেত্রেই শিকার হচ্ছেন সুপরিকল্পিত ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকাণ্ডের (Targeted assassination)। সংঘাত কবলিত এলাকায় এই ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ শিকার ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ ও তার চার সহকর্মী। এই হত্যাকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কতটা ঝুঁকির মধ্যে থেকে একজন সাংবাদিককে মানবাধিকার রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর দিন শেষে যার জন্য চুকাতে হয় চরম মূল্য, নিজের প্রাণ।
অস্ত্রছাড়া অনন্য যোদ্ধা
বিজ্ঞাপন
সংঘাত কবলিত ও অপরাধ প্রবণ এলাকায় একজন সাংবাদিককে অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারণ এসব এলাকাতেই মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রান্ত অনেক ঘটনা ঘটে থাকে। আর তাই ঝুঁকিপূর্ণ এমন এলাকায় নোট প্যাড, কলম, ক্যামেরা, রেকর্ডারসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে যান এক সংবাদ কর্মী।
আর এই সাংবাদিকের নিরাপত্তায় থাকে শুধুই একটি হেলমেট আর প্রেস নাম অঙ্কিত বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। দুটো পরিধেয় বস্তুই সাংবাদিকের প্রধান নিরাপত্তা বর্ম। অথচ সাংবাদিককে মুখোমুখি হতে হয় বুলেট-বোমার। এছাড়া সুপরিকল্পিত ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকাণ্ডের জন্য সময় মাথার ওপর চক্কর দেয় ড্রোন অথবা বহু দূর থেকে নিশানা ঠিক করে স্নাইপার রাইফেল।
শুধুমাত্র পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিকরা প্রতিদিন আক্রমণ, হুমকি এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছেন।
আধুনিক বিশ্বে বিশ্ব মানবতার জন্য গাজা এক কলঙ্কতিলক। দিনের পর দিন নেতানিয়াহুর ইসরায়েল বর্বর যুদ্ধাপরাধ করে গেলেও বিশ্ব সম্প্রদায় এই সংঘাত থামাতে পারছে না। গাজা এখন এক করুণ মৃত্যু উপত্যকা, মানবতার লজ্জা। শুধু বুলেট-বোমা ও ট্যাঙ্কের গোলা নয় এই ভূ-খণ্ডের প্রায় ১২ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে ক্ষুধাকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে জায়নবাদীরা।
অন্যদিকে এক বছর ১০ মাস ধরে চলা এই সংঘাতের সংবাদ প্রচার ও প্রকাশেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইসরায়েল। যে কারণে অনেক বিদেশি সাংবাদিক গাজায় প্রবেশ করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গাজায় কর্মরত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের তাদের প্রতিনিধি বা কর্মী হিসেবে নিয়োজিত করছেন। যারা বিশ্ববাসীর সামনে ইসরায়েলি বর্বরতা তুলে ধরতে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন সিপিজে (কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট) জানাচ্ছে ২০২৫ সালের ১১ আগস্ট বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার ৬ সংবাদকর্মীসহ এই অসম যুদ্ধে প্রাণ হারানো সংবাদকর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯২ জনে। যাদের মধ্যে ১৮৪ জনই ফিলিস্তিনের নাগরিক।
মৃত্যু বার্তা লিখে সংবাদ সংগ্রহে বের হচ্ছেন সংবাদকর্মীরা
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকেই গাজা সাংবাদিকদের জন্য এক মৃত্যু উপত্যকা। সংঘাত কবলিত এলাকায় গণমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্যবস্তু না করা, হামলা না করা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হলেও ইসরায়েলি বাহিনী তাতে কোনো কর্ণপাত করেনি। এখনো পর্যন্ত ১৮৪ জনই ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের বেশিরভাগই নিহত হয়েছেন সরাসরি, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু কেন্দ্রিক হামলায়। যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যুদ্ধাপরাধের সামিল।
সর্বশেষ আল-শিফা হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের তাঁবুতে পরিকল্পিত ড্রোন হামলা চালায় আইডিএফ (ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স)। যাতে আল-জাজিরার আনাস আল-শরীফসহ মোট সাতজন প্রাণ হারান। এটা নিশ্চিতভাবেই একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এটি অগ্রহণযোগ্য, যুদ্ধাপরাধ।
কিন্তু বর্বর ইসরায়েলি সেনাদের তা বুঝাবে কে? সে কারণে গাজার কর্মরত বেশিরভাগ সাংবাদিক এখন সংবাদ সংগ্রহে নামছেন নিশ্চিত মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়ে। ১১ আগস্ট ঘৃণ্য হত্যার শিকার আল-জাজিরার পরিচিত মুখ সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ জানতো যেকোনো সময় ইসরায়েলি বোমা তার জীবন শেষ করে দিতে পারে।
তাই তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে গেছেন ভয়াবহ এই যুদ্ধ নিয়ে তার বেদনা ও হতাশার কথা। পূর্বে লেখা এক মৃত্যু বার্তায় মাত্র ২৮ বছর বয়সী আনাস বিশ্ববাসীকে জানিয়ে গেছেন তার শেষ অভিব্যক্তি, ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আনাস লিখেছেন, তিনি যন্ত্রণার প্রতিটি ক্ষুদ্রতম রূপ অনুভব করেছেন।
বারবার দুঃখ ও ক্ষতির স্বাদ পেয়েছেন। তিনি অভিমান করে লিখেছেন, আমাদের শিশু ও নারীদের ক্ষতবিক্ষত দেহও তাদের (বিশ্ববাসীর) হৃদয়কে নড়াতে পারেনি, কিংবা দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের জনগণের ওপর চলা হত্যাযজ্ঞ থামাতে পারেনি। তিনি গভীর বেদনার সাথে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, ছেলেমেয়ের বড় হওয়াটা হয়তো তিনি দেখে নাও যেতে পারেন। হয়েছেও তাই। ইসরায়েলি খুনে ড্রোন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে আনাসের শরীর। যদিও ঘরে অপেক্ষা করছে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান।
সাংবাদিকতা অতি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা: ইউনেস্কো
জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকদের পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করে আসছে। একইসাথে সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ কর্ম পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করে আসছে।
২০২১ সালে সংস্থাটি Journalism: A dangerous profession শিরোনামের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধটির লেখক লিনডা ক্লাসান (Linda Klaassen) স্পষ্ট করে বলেছেন, শুধুমাত্র পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিকরা প্রতিদিন আক্রমণ, হুমকি এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছেন। জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা প্রাণ হারাচ্ছেন। (Attacks, intimidation, and even murder. Journalists across the world face serious risks and threats every day, just for doing their jobs – reporting the news and bringing information to the public.)
২০২৫ সালের প্রথম ভাগে সারাবিশ্বে এখনো পর্যন্ত ২৪ জন সংবাদকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আর বলপূর্বক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ৫৬৪ জন সাংবাদিক ও সহায়ক কর্মী। যার মধ্যে বাংলাদেশি রয়েছেন ৮ জন।
ওই প্রতিবেদনে সে সময় বলা হয়েছিল বিশ্বে প্রতি চার দিনে একজন করে সাংবাদিক হত্যার শিকার হচ্ছিলেন। আল-জাজিরা জানাচ্ছে বর্তমানে ২০২৫ সালে শুধু গাজাতেই প্রতি মাসে হত্যার শিকার হচ্ছেন ১৩ জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী।
যুদ্ধ-সংঘাত ছাড়াও প্রাণ যাচ্ছে সাংবাদিকদের
শুধু যুদ্ধ বা সংঘাত কবলিত এলাকায় নয়, কর্তৃত্বপরায়ণ ও অপরাধপ্রবণ সমাজেও অপরাধীদের সহজ লক্ষ্য সাংবাদিকরা। কয়েকদিন আগে ঢাকার উপকণ্ঠ গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। তুহিনকে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সদস্যরা হাজারো মানুষের মধ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। যে হত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।
সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারও (আরএসএফ) এই হত্যার নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়েছে। শুধু তাই নয় সংস্থাটি জানাচ্ছে ২০২৫ সালের প্রথম ভাগে সারাবিশ্বে এখনো পর্যন্ত ২৪ জন সংবাদকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আর বলপূর্বক কারাগারে (arbitrary detention ) নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ৫৬৪ জন সাংবাদিক ও সহায়ক কর্মী। যার মধ্যে বাংলাদেশি রয়েছেন ৮ জন।
আরও পড়ুন
ওয়াল্টার কনক্রাইট (Walter Cronkite) নামে একজন বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন। যিনি সম্প্রচার সাংবাদিকতাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করেছিলেন, ছিলেন মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম এনবিসি এর মুখপাত্র। তাকে বলা হতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কণ্ঠস্বর (most trusted man in America)। মার্কিনিরা তাকে প্রবল বিশ্বাস করতেন।
এই গুণী সাংবাদিক বলেছিলেন, গণতন্ত্রের জন্য সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা শুধু প্রয়োজনীয়ই নয়, এই স্বাধীনতা-ই গণতন্ত্র। বহু রক্ত বিসর্জনের পর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের এক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি বড় বিষয়। যা নিশ্চিতে বাংলাদেশে যে আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হবে, অনেক সাংবাদিককে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে তা বলাই বাহুল্য।
সহায়ক:-
১। Journalism: A dangerous profession (Article by Linda Klaassen for UNESCO), Retrieved on 24 September 2025. https://courier.unesco.org/en/articles/journalism-dangerous-profession
২। Here are the names of the journalists Israel killed in Gaza (Al Jazeera, online) Retrieved on 24 September 2025. https://www.aljazeera.com/news/2025/8/11/here-are-the-names-of-the-journalists-israel-killed-in-gaza
রাহাত মিনহাজ : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়