হাতিরঝিলে গেলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। সবুজ আর পরিচ্ছন্ন ফুটপাত। পুরো অংশ জুড়েই রয়েছে লেক। যদিও লেকের পানিতে সবুজ শেওলা ভাসমান। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। যতবার যাওয়া যায় ততবারই ভালো লাগে। সেখান থেকে ফেরার সময় মনটা সবসময় ভারী হয়ে ওঠে।

৩০০ ফিট যেন আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেশানো এক নান্দনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পরিচ্ছন্ন ঢাকার ভবিষ্যৎ ছবি। পূর্বাচল যেন সেই ঢাকাকেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে। স্বপ্ন কি সুদূর পরাহত নাকি বাস্তবের খুব কাছাকাছি? তা নিজের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ।

উদ্ভট ট্রাফিক জ্যাম, অপরিচ্ছন্ন ফুটপাত, রং ওঠা বিভিন্ন রুটের বাসসহ নোংরা সব গণপরিবহন। ব্রিটিশ আমলের সেই হাত উঠানো ট্রাফিক সিস্টেম। নিয়ম না মানার হাজারও গল্পের সম্মিলন। মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্টকারী হাজারও বাসের হাঁকডাক। এখন তো আবার ঢাকাকে বদলে দেওয়ার জন্য একসঙ্গে সারা ঢাকায় উন্নয়ন কাজের গল্প।

একঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা হয়ে ওঠে ডুবন্ত শহর। এক ঢাকায় এলাকাভিত্তিক অনেক নদীর সমাহার। হায়রে ড্রেনেজ সিস্টেম! আমার ঢাকা শৈশব পার করে কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে পৌঢ় যুবক। সিস্টেম যা ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। জনসংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। সারা ঢাকা শহর হয়ে ওঠে ডিজেল, অকটেন আর পোড়া মবিল মাখানো এক কর্দমাক্ত শহর। সত্যি এক বিভীষিকাময় দমবন্ধ করা পথচলা।

চলার পথে হঠাৎ পা ফসকে গেলেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ছুটে চলা কোনো এক গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে যাওয়া। এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদের ভাষায়, “একটি দুর্ঘটনা, একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না”। এ কান্না বয়ে বেড়াতে হয় কয়েক পুরুষ। কে নেবে এর দায়ভার? কার কাছে পাওয়া যাবে এর বিচার?

ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলা যাবে না—এটা একটা সিদ্ধান্ত মাত্র, তেমনি রুট ভিত্তিক গাড়ির রং থাকাটা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটা সার্কুলার জারির প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

পোস্টার, লিফলেট রাস্তার পাশের দেয়ালে লাগানো যাবে না, এমনকি দেয়াল লিখন ও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিংবা ওভারব্রিজে ভিক্ষুকের উপদ্রব সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ইচ্ছে করলেই দূর করতে পারে, শুধু দরকার সদিচ্ছা।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ওভার ব্রিজ, পথচারীদের উপকারে না আসলেও উপকার হয় ভবঘুরেদের। যারা নির্বিঘ্নে সহজেই রাত্রিযাপন করতে পারে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ঢাকাকে বদলে যেতে দেখেছি বারবার। সারা ঢাকা শহরে রোড ডিভাইডার যে কতবার পরিবর্তিত হয়েছে, আধুনিকায়নের নামে ফুটপাতের সৌন্দর্যবর্ধন হয়েছে নাকি ফুটপাত বিলীন হয়েছে বুঝে উঠতে পারছি না।

ঢাকা শহরে বেশকিছু লিফটযুক্ত (এক্সিলেটর) ওভারব্রিজ লাগানো হয়েছে কিন্তু কার জন্য আসলে লাগানো হয়েছে এইসব লিফট? কখনো কি লিফটগুলো সচল থেকেছে? এতে মানুষের উপকার না হয়ে উল্টো ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠছে এই লিফট সর্বস্ব ওভারব্রিজগুলো।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর কথাই ধরা যাক, আমাদের তুলনায় ছোট শহর, জনসংখ্যাও কম কিন্তু শহরে ধুলাবালি নেই বললেই চলে। তেমনি কম জনসংখ্যার দেশ ভুটানের রাজধানী থিম্পুতেও কাদা ধুলাবালির সন্ধান পাওয়া যায় না। কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাস্তার দু’পাশে সুন্দর পরিচ্ছন্ন ফুটপাত, মাটির দেখা নাই বললেই চলে, তাই ধুলাবালি আর কাদার অস্তিত্ব দেখা যায় না।

ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুরের উদাহরণ নাইবা তুলে ধরলাম। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর শহরের কেন্দ্রবিন্দু পৌঁছানো পর্যন্ত কোথাও ধুলাবালি কিংবা কাদামাটির দেখা পাওয়া যায় না। একটু বৃষ্টি হলে সেসব শহরগুলো আরও সুন্দর আর সবুজে ভরে ওঠে। মন হয়ে ওঠে উৎফুল্ল।

আমাদের শহরগুলোর সৌন্দর্য বর্ধনের দায়িত্ব যাদের হাতে তারা সবসময়ই এই দেশগুলোয় ভ্রমণ করে থাকেন। বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে সেসব দেশের সৌন্দর্য উপভোগ করেন, সেকেন্ড হোম করার পরিকল্পনা সাজান, নিজের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিরূপণের জন্য চিন্তা আর চেতনায় লালন করেন। কিন্তু নিজ দেশের বিমানবন্দরে নেমেই সবকিছু বেমালুম ভুলে যান যে, এই দেশের ছবি বদলানের দায়িত্ব যে উনাদের কাঁধেই রয়েছে।

যে দেশে রডের বদলে বাঁশের ব্যবহার, সিমেন্টের বদলে মাটির ব্যবহার করা মানুষের অভাব হয় না, সেখানে আপনি শহরের অবকাঠামো পরিবর্তনের নীতিনির্ধারক সহজে পেয়ে যাবেন তা ভাবার কোনো কারণ নেই।

হাজার হাজার টাকা দিয়ে বালিশ কেনার রেকর্ডের কথা তো আমরা সবাই জানি। দু’চার টাকার সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা হয় শতশত টাকায়। মহামারি করোনাকালীন সময়ে করোনার টেস্ট না করেই হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল, কতটুকু নৈতিক স্খলন ঘটলে এ ধরনের কাজ করতে পারে তা অচিন্তনীয়।

আমাদের ক্যান্টনমেন্টগুলো কিংবা সেনা, নৌ বা বিমানবাহিনীর ঘাঁটিগুলোয় ভ্রমণ করলেই দেখতে পাবেন সামরিক আর বেসামরিক এলাকার মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। সুন্দর অটোমেটেড ট্রাফিক সিস্টেম, সুন্দর ফুটপাত, ড্রেনেজ সিস্টেম, চারিদিকে সবুজের সমারোহ, স্পিড মিটার সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া। মন ভালো করা পরিবেশ। ঢাকা শহরের আধুনিকায়নের দায়িত্ব যাদের উপর অর্পিত তাদের বিশ্ব ভ্রমণ না করে শুধু ক্যান্টনমেন্টগুলো ভ্রমণ করলেই পরিচ্ছন্ন শহর উপহার দিতে পারবে নগর ট্যাক্স প্রদান করা নাগরিকদের।

ঢাকার রাস্তায় ইদানীং দৃষ্টিনন্দন মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস কিংবা ৩৬ জুলাই এভিনিউ সাধারণ নাগরিকদের কাছে ৩০০ ফিট নামেই পরিচিত, যা আধুনিক ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে এক ধাপ এগিয়েছে। কিছুটা যানজট কমেছে মেট্রো আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসের কারণে। সাবেক মেয়র আনিসুল হক-এর সুচিন্তিত ভাবনার ফসল ঢাকা শহর থেকে বিলবোর্ড উচ্ছেদকরণ। যার ফলে এ শহরকে তিনি কিছুটা উন্মুক্ত করতে পেরেছেন।

সারাদেশের ন্যায় লাখ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা নামক বাহন রাজধানী ঢাকাকে গিলে খাচ্ছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যত্রতত্র ফুটপাতে গড়ে ওঠা হকার্স মার্কেট ঢাকার নাগরিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নামীয় বস্তি, যা ঢাকার সৌন্দর্য হানি ঘটাচ্ছে।

অবৈধ দখলদারিত্ব তো সব সরকারের আমলেই চলে আসছে। খাস জমি, খাল বিল থেকে শুরু করে ঢাকাকে ঘিরে রাখা তুরাগ আর প্রাচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত বুড়িগঙ্গাকে দখল করে বিশাল বিশাল অট্টালিকা গড়ে তুলতে দেখা যাচ্ছে। সব সম্ভবের দেশে ঢাকাকে আধুনিক ঢাকায় রূপান্তর করতে প্রয়োজন সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামো। সিটি কর্পোরেশনসহ সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা প্রণয়ন খুবই দরকার।

নিজের শহরকে নিজের মতো করে পেতে বদলাতে হবে পুরাতন ধ্যান ধারণা, মানসিকতায় হতে হবে আধুনিক। নিয়মের শৃঙ্খলে নিজেকে সমর্পিত করে সুন্দর ঢাকার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হবে। আসুন প্রথমে নিজে বদলাই, পরে পারিপার্শ্বিকতা বদলাই, তাহলেই আপনার শহর বদলে যাবে।

আপনার শহর বদলালে আপনার, আমার প্রিয় দেশ বাংলাদেশ বদলে যাবে। সুন্দর আগামীর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে, নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশৃঙ্খল জাতি উপহার দিতে আজ থেকেই পরিবর্তন শুরু হোক। শুরু হোক সুন্দরের সাথে সুন্দরের পথচলা।

মো. কামরুল ইসলাম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট