ডিজিটাল যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী ও দ্বিমুখী (Double sword) আবিষ্কার হলো সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এটি একদিকে যেমন নাগরিক সংহতি, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার, অন্যদিকে তেমনি রূপান্তরিত হচ্ছে সংঘাত, বিভাজন ও সহিংসতার উর্বর ক্ষেত্রে।

টোডা পিস ইন্সটিটিউটের (Toda Peace Institute) গবেষণা (Schirch, ২০২০) এবং অন্যান্য তাত্ত্বিক সূত্র অনুসারে, সামাজিক মাধ্যম কেবল বিনোদন ও পরিবর্তনের রূপকার নয়; এটি সক্রিয়ভাবে সংঘাতের গতিপথ নির্মাণ ও পরিবর্ধন করছে। এই প্রবন্ধে সামাজিক মাধ্যম কীভাবে সংঘাত তৈরি ও ত্বরান্বিত করে—তা তাত্ত্বিক কাঠামো এবং বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক উদাহরণসহ বিশ্লেষণ করা হলো।

তাত্ত্বিক ভিত্তি: কেন সামাজিক মাধ্যম সংঘাত তৈরি করে?

সামাজিক মাধ্যম ও সংঘাতের মধ্যে সম্পর্ক বোঝার জন্য কয়েকটি তাত্ত্বিক ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। Shoshana Zuboff-এর ‘Surveillance Capitalism’ তত্ত্ব অনুযায়ী, সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহ করে এবং আবেগ-ভিত্তিক কনটেন্ট প্রদর্শনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মনোযোগ ধরে রাখে। এখানে রাগ, ভয় ও ঘৃণাই সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলে, যা সংঘাতের জন্য উর্বর ভূমি তৈরি করে।

অপরদিকে, প্ল্যাটফর্মের ‘Algorithmic Amplification’ এমনভাবে কাজ করে যে, যে কনটেন্ট সবচেয়ে বেশি লাইক, শেয়ার বা কমেন্ট পায় সেটিই বেশি প্রচারিত হয়। এতে বিভাজনমূলক, উত্তেজনাপূর্ণ বা মিথ্যা তথ্য দ্রুত ভাইরাল হয় এবং ব্যবহারকারীরা প্রতিধ্বনি কক্ষে বন্দি হয়ে পড়ে।

Jürgen Habermas-এর ‘Public Sphere’ তত্ত্ব অনুসারে, গণতন্ত্রের জন্য একটি মুক্ত ও যুক্তিভিত্তিক আলোচনার ক্ষেত্র প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিকমাধ্যম সেই আলোচনাকে বিকৃত করে, যেখানে যুক্তির বদলে আবেগ, গুজব ও ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রাধান্য পায়। যা ইদানীং সমাজে সংঘাত ও সহিংসতা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

মিথ্যা তথ্য: গুজব থেকে মব লিঞ্চিং

মিথ্যা তথ্য বা ‘Disinformation’ সামাজিক মাধ্যমের সবচেয়ে বড় হুমকি। এটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং সরাসরি সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে ২০১৭-১৮ সালে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভুয়া ভিডিও ভাইরাল হয়, যাতে শিশু অপহরণের দৃশ্য দেখানো হয়। এতে উত্তেজিত হয়ে জনতা অন্তত ৩৩ জনকে পিটিয়ে হত্যা করে।

ব্রাজিলে ‘Guarujá Alerta’ নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে গুজব ছড়ায় যে, এক নারী শিশু চুরি করে জাদুবিদ্যা করে। ভুল সন্দেহে জনতা Fabiane de Jesus-কে পিটিয়ে হত্যা করে। বাংলাদেশেও ২০১২ সালে রামুতে ফেসবুকে একটি ভুয়া ছবি পোস্টকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধবিহার ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।

২০১৯ সালে ভোলায় ফেসবুকে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত হন। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টকে কেন্দ্র করে মব করে মানুষের সম্পদ বিনষ্টসহ শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। মাইনরিটি সম্প্রদায় এ সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে।

রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও প্রোপাগান্ডা

আজকের পৃথিবীতে সামাজিকমাধ্যম কেবল মতপ্রকাশের ক্ষেত্র নয়, বরং রাজনৈতিক হাতিয়ার। অনেক কর্তৃত্ববাদী (authoritarian) রাষ্ট্র এটি ব্যবহার করছে দমন-পীড়ন, নজরদারি ও প্রোপাগান্ডার জন্য। ভেনেজুয়েলায় সরকার ‘ট্রোল আর্মি’ গঠন করে, যারা বিরোধীদের হ্যাশট্যাগ দখল করে, ভুয়া খবর ছড়ায় এবং কর্মীদের হয়রানি করে।

মিথ্যা তথ্য বা ‘Disinformation’ সামাজিক মাধ্যমের সবচেয়ে বড় হুমকি। এটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং সরাসরি সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।

মিশরে ২০১৮ সালের সাইবারক্রাইম আইন অনুসারে, পাঁচ হাজারের বেশি অনুসারী থাকলে কোনো ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট বন্ধ বা সেন্সর করা যায়। সেখানে কর্মীদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয় এবং ভুয়া অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। মিয়ানমারে ফেসবুকের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা জাতিগত নিধনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

অ্যালগরিদম ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা

সামাজিকমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবসায়িক মডেলই আসলে বিভাজনকে উসকে দেয়। কারণ তাদের আয় আসে বিজ্ঞাপন থেকে, আর বিজ্ঞাপন টিকে থাকে ব্যবহারকারীর দীর্ঘ সময় প্ল্যাটফর্মে থাকার ওপর। তাই যেসব কনটেন্ট মানুষের আবেগকে উত্তেজিত করে—যেমন ঘৃণা, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা মিথ্যা তথ্য—সেগুলো অ্যালগরিদম দ্বারা বেশি প্রচারিত হয়।

Zuboff-এর মতে, এটি হলো ‘behavioral surplus’—ব্যবহারকারীর আচরণকে পণ্য বানিয়ে মুনাফা করা, যার সামাজিক মূল্য হলো সংঘাত বৃদ্ধি।

যোগাযোগমাধ্যম, হানি ট্র্যাপ ও সংঘাত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আজ হানি ট্র্যাপও সংঘাত সৃষ্টির অন্ধকার কৌশলকে সহজ করে তুলেছে। হানি ট্র্যাপ হলো এমন একটি প্রলোভনমূলক কৌশল যেখানে ভুয়া প্রোফাইল, রোমান্টিক বার্তা বা আকর্ষণীয় ছবি ব্যবহার করে কাউকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ফাঁদে ফেলা হয় এবং পরে তার কাছ থেকে সংবেদনশীল তথ্য আদায়, আর্থিক ব্ল্যাকমেইল বা রাজনৈতিক চরিত্রহননের জন্য ব্যবহার করা হয়।

ভারতে একাধিকবার পাকিস্তানি গোয়েন্দারা ভুয়া নারী প্রোফাইল ব্যবহার করে সেনাদের ফাঁদে ফেলেছে; বাংলাদেশেও সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মী ও কর্মকর্তাদের টার্গেট করার অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনার মাধ্যমে শুধু ব্যক্তিগত সংকট নয় বরং সামাজিক বিভাজন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এমনকি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও সংঘাত তৈরি হয়। অ্যালগরিদম-নির্ভর সামাজিক মাধ্যম দ্রুত এই ধরনের তথ্য ভাইরাল করে, ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়ে।

বাংলাদেশ: প্রাসঙ্গিকতা ও উদাহরণ

বাংলাদেশে সামাজিকমাধ্যম রাজনৈতিক মেরুকরণ ও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মঞ্চে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ফেসবুক ও ইউটিউব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আন্দোলনের বার্তা মুহূর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আজ হানি ট্র্যাপও সংঘাত সৃষ্টির অন্ধকার কৌশলকে সহজ করে তুলেছে। হানি ট্র্যাপ হলো এমন একটি প্রলোভনমূলক কৌশল যেখানে ভুয়া প্রোফাইল, রোমান্টিক বার্তা বা আকর্ষণীয় ছবি ব্যবহার করে কাউকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ফাঁদে ফেলা হয়...

২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ও সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া ভিডিও, বিকৃত অডিও ও উসকানিমূলক কনটেন্ট ছড়িয়ে সহিংসতা উসকে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ধর্মীয় উসকানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেষ্টা হয়েছে। এসব প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় সামাজিক মাধ্যম একদিকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার, অন্যদিকে সহিংসতার কারণও হতে পারে।

সমাধানের দিকে: একটি শান্তি-নির্মাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি

সংঘাত প্রশমনে কেবল প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ নয় বরং একটি সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

প্রথমত, নাগরিকদের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়াতে হবে যাতে তারা গুজব ও ভুয়া তথ্য চিহ্নিত করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি কোম্পানিকে তাদের অ্যালগরিদম স্বচ্ছ করতে হবে এবং মিথ্যা তথ্যের চেয়ে নির্ভুল তথ্যকে প্রাধান্য দিতে হবে।

তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম, ধর্মীয় নেতা ও সুশীল সমাজকে অনলাইনে শান্তি ও সহনশীলতার বার্তা ছড়াতে হবে।

চতুর্থত, সরকারকে এমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা পাবে, আবার একই সঙ্গে ক্ষতিকর কনটেন্ট থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া হবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সংঘাতের এক ‘force multiplier’—এটি বিদ্যমান বিভাজনকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে এবং নতুন সংঘাতের জন্ম দেয়। Surveillance capitalism, algorithmic design, রাজনৈতিক স্বার্থ এবং সামাজিক দুর্বলতা—সবকিছু মিলেই এটি একটি জটিল প্রক্রিয়ায় রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা দেখায় যে, জবাবদিহি ছাড়া সামাজিক মাধ্যম সমাজের সংহতি ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই সময় এসেছে প্রযুক্তিকে শান্তি ও সংহতির হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাত্ত্বিকভাবে সচেতন, নীতি-নির্ভর ও বহুপক্ষীয় পদক্ষেপ নেওয়ার। অন্যথায়, ডিজিটাল যুগের এই মহান আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে বিভাজন ও সংঘাতের নতুন অন্ধকার পথে ঠেলে দিতে পারে।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম : অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়