জলবায়ু গবেষণা, সম্মেলন ও চুক্তির প্রায়োগিক প্রভাব
দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। কিন্তু এর প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ যেন গবেষণাপত্র ও সংবাদপত্রের পাতাতেই সীমাবদ্ধ। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রকাশিত গবেষণার সংখ্যা সত্যিই বিস্ময়কর—কয়েক লাখ বা তারও বেশি। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এই বিপুল গবেষণার ফল কতটা কার্যকর?
এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে শুধু ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৮৮,০০০ গবেষণাপত্র। অন্যান্য ভাষা ও উৎস যোগ করলে এই সংখ্যা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। এই বিপুল গবেষণা ও গণমাধ্যম প্রতিবেদন একটাই সত্য প্রমাণ করে—আমরা সংকটটি বিশ্লেষণ ও নথিভুক্ত করতে পারদর্শী, কিন্তু বাস্তব পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ। এত গবেষণার পরও সমাধান এখনও কেবল বক্তৃতার ভাষায় সীমাবদ্ধ; আমরা কেবল নিষ্ক্রিয়তার ইতিহাস রচনায় ব্যস্ত।
বিজ্ঞাপন
গবেষণার মতোই জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোও একই বাস্তবতা তুলে ধরে। প্রথম বড় চুক্তি ছিল মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল (১৯৮৭), যার লক্ষ্য ছিল ওজোন স্তর ধ্বংসকারী পদার্থ—বিশেষত ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC)—ক্রমে বন্ধ করা। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছিলেন, ওজোন স্তরের ক্ষয় পৃথিবীতে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ করায়, যা মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য গুরুতর হুমকি।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে গৃহীত এ চুক্তিতে ১৯৭টি দেশ স্বাক্ষর করে, যা ইতিহাসের সর্বাধিক অনুমোদিত চুক্তিগুলোর একটি। এর প্রভাবও তাৎপর্যপূর্ণ, এটি শুধু ওজোন স্তর পুনরুদ্ধার করেনি বরং পরোক্ষভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাস করে বিলিয়ন টন CO₂ নির্গমন রোধ করেছে। তবে এটি সরাসরি কার্বন ডাই-অক্সাইড বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলা করতে পারেনি, যা পরবর্তীতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণে UNFCCC প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেয়।
বিজ্ঞাপন
১৯৯২ সালের রিও আর্থ সামিটে গৃহীত জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC) জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি করে। এর মূল লক্ষ্য ছিল গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব স্থিতিশীল রেখে জলবায়ু ব্যবস্থায় বিপজ্জনক হস্তক্ষেপ রোধ করা।
এখানে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্রমবর্ধমান প্রমাণ ও এর সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়। ১৫৪টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে এবং পরবর্তীতে প্রায় সব দেশই তা অনুমোদন করে। এই কনভেনশন থেকেই বার্ষিক COP (Conference of the Parties) প্রক্রিয়ার সূচনা হয়।
তবে এটি ছিল কেবল একটি কাঠামোগত চুক্তি, কোনো বাধ্যতামূলক আইন নয় UNFCCC-এর অধীনে প্রথম আইনি বাধ্যতামূলক চুক্তি হিসেবে কিয়োটো প্রোটোকল (১৯৯৭) শিল্পোন্নত দেশগুলো ২০০৮–২০১২ সময়ে ১৯৯০ সালের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে বাধ্য করে। এখানে বৈজ্ঞানিক ঐকমত্য ছিল যে স্বেচ্ছামূলক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়, বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।
চুক্তিটি উন্নত দেশগুলোর জন্য নির্গমন বাণিজ্য ও ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজমের মতো ব্যবস্থা চালু করলেও এর প্রভাব সীমিত ছিল—যুক্তরাষ্ট্র এতে অংশ নেয়নি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। এই সীমাবদ্ধতা পরবর্তীতে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নমনীয় কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা সামনে আনে, যা কোপেনহেগেন অ্যাকর্ডের জন্ম দেয়।
কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড (২০০৯) ছিল একটি রাজনৈতিক চুক্তি, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২°C-এর নিচে সীমিত করার প্রয়োজনীয়তা শর্তহীনভাবে স্বীকার করে এবং ‘জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান’ (NDC) ধারণা চালু করে। কিয়োটো প্রোটোকলের সীমিত কাঠামো ও কভারেজ বৈশ্বিক নির্গমন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায়, সব দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল। এর ফলেই COP15-এ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বৃহৎ অর্থনীতিগুলো এই অ্যাকর্ড খসড়া করে।
এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে শুধু ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৮৮,০০০ গবেষণাপত্র। অন্যান্য ভাষা ও উৎস যোগ করলে এই সংখ্যা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। এই বিপুল গবেষণা ও গণমাধ্যম প্রতিবেদন একটাই সত্য প্রমাণ করে—আমরা সংকটটি বিশ্লেষণ ও নথিভুক্ত করতে পারদর্শী, কিন্তু বাস্তব পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ।
যদিও এটি আইনি বাধ্যতামূলক ছিল না, তবে স্বেচ্ছামূলক প্রতিশ্রুতি ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে বৈশ্বিক অংশগ্রহণের নতুন ধারা সৃষ্টি করে। তবে শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থা ও আনুষ্ঠানিক আইনি মর্যাদার অভাব থেকে যায়, যা পরবর্তীতে ক্যানকুন চুক্তির প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে।
ক্যানকুন চুক্তি (২০১০) ছিল UNFCCC-এর অধীনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর একটি সেট, যা কোপেনহেগেনের প্রতিশ্রুতি আনুষ্ঠানিক করে, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বচ্ছতা কাঠামো উন্নত করে। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশ্রুতিগুলো কার্যকর করা ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন ও প্রশমনে আর্থিক সহায়তা প্রদান। COP16-এ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এই চুক্তি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে আস্থা জোরদার করলেও, এটি এখনো একটি বাধ্যতামূলক বৈশ্বিক চুক্তিতে পরিণত হতে পারেনি—যা পরবর্তীতে প্যারিস চুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে।
প্যারিস চুক্তি (২০১৫) ছিল একটি ঐতিহাসিক বৈশ্বিক উদ্যোগ, যার লক্ষ্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২°C-এর নিচে রাখা এবং ১.৫°C সীমায় আনার প্রচেষ্টা জোরদার করা। পূর্ববর্তী চুক্তিগুলোর সীমাবদ্ধতার কারণে জরুরি বৈজ্ঞানিক সতর্কতা ও একটি সর্বজনীন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই COP21-এ ১৯৫টি দেশ এই চুক্তি গ্রহণ করে।
দেশগুলো নিজেদের ‘জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান’ (NDC) জমা দেয় এবং পাঁচ বছর অন্তর তা নবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়—যা একে পূর্ববর্তী কাঠামোর তুলনায় বেশি কার্যকর করে তোলে। এটি টপ-ডাউন লক্ষ্য থেকে সরে এসে দেশভিত্তিক উদ্যোগে রূপ নেয় এবং স্বচ্ছতা ও অর্থায়নের নিশ্চয়তা দেয়। তবে বাস্তবায়নের ঘাটতি ও উচ্চাভিলাষের অভাব এখনো রয়ে গেছে, যা কিগালি সংশোধনের মতো পরিপূরক পদক্ষেপের প্রয়োজন সৃষ্টি করে।
কিগালি সংশোধনী (২০১৬) মন্ট্রিয়ল প্রোটোকলের অধীনে গৃহীত এই সংশোধনী হাইড্রোফ্লুরোকার্বন (HFC) নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে—যা রেফ্রিজারেশনে ব্যবহৃত শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। বায়ুমণ্ডলে HFC-র দ্রুত বৃদ্ধি ওজোন পুনরুদ্ধির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছিল।
১৯৭টি রাষ্ট্রপক্ষের আলোচনায় গৃহীত এই সংশোধনী ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ০.৫°C পর্যন্ত কমাতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি প্যারিস চুক্তির সম্পূরক হিসেবে জলবায়ু পদক্ষেপে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি আরও শক্তিশালী করে।
এত শত চুক্তি ও সম্মেলনের কোনোটিই আইন বা আদেশে রূপ লাভ করতে পারেনি। এর পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে।
প্রথমত, জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিষয়গুলো দেশগুলোকে তাদের অর্থনৈতিক ও জ্বালানি নীতির ওপর বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। বাধ্যতামূলক নির্গমন লক্ষ্যমাত্রা প্রায়শই স্বায়ত্তশাসন হারানোর মতো মনে হয়, বিশেষ করে সেই সব জাতির কাছে যারা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অগ্রাধিকার দেয়।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বৈশ্বিক বৈষম্য সংঘাত তৈরি করে। উন্নত দেশগুলোর পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য বেশি সম্পদ রয়েছে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো আশঙ্কা করে যে কঠোর আইন তাদের প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে। এই ভারসাম্যহীনতা ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়।
তৃতীয়ত, এর প্রয়োগ (enforcement) জটিল, কারণ শাস্তি আরোপ করার মতো কোনো বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ নেই। আইনি নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে সম্মতি নির্ভর করে স্বেচ্ছায় সহযোগিতা, প্রতিবেদন দাখিল এবং পারস্পরিক চাপের ওপর, যা যেকোনো বাধ্যতামূলক চুক্তির কার্যকারিতা দুর্বল করে দেয়।
চতুর্থত, ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় অগ্রাধিকার ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন করে তোলে। কিছু দেশ শিল্প প্রবৃদ্ধি ও জ্বালানি নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়, যখন অন্যরা জলবায়ু সহনশীলতার ওপর মনোযোগ দেয়। এই পরস্পরবিরোধী স্বার্থগুলো একটি আইনি কাঠামোর অধীনে আনা বড় একটি বাধা।
জলবায়ু চুক্তিগুলো সত্যিকারের অর্থপূর্ণ করে তুলতে হলে, এই কাঠামোকে অবশ্যই একটি স্বেচ্ছামূলক ‘ভদ্রলোকের চুক্তি’ থেকে একটি বাধ্যতামূলক আইনি চুক্তিতে রূপান্তরিত হতে হবে...
পঞ্চমত, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চক্র ও শক্তিশালী জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পগুলোর লবিং প্রায়শই জলবায়ু আইনের বিরোধিতা করে, যার ফলে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেও তা অনুমোদন (ratification) করা কঠিন হয়ে পড়ে।
অবশেষে, অর্থনৈতিক প্রভাব ও প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা দ্বিধা সৃষ্টি করে। সরকারগুলো আশঙ্কা করে যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস করতে পারে বা অপ্রত্যাশিত ব্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা তাদের কঠোর আইনি বাধ্যবাধকতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক করে তোলে।
এই সম্মিলিত কারণগুলো ব্যাখ্যা করে কেন কিয়োটো প্রোটোকলের মতো চুক্তিগুলোয় সীমিত অংশগ্রহণ দেখা গেছে এবং কেন প্যারিস চুক্তি জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের (nationally determined contributions) মাধ্যমে আরও নমনীয়, অবাধ্যতামূলক পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। চ্যালেঞ্জটি বৈজ্ঞানিক ঐকমত্যে নয় বরং রাজনৈতিকভাবে খণ্ডিত বিশ্বে সার্বভৌমত্ব, সমতা এবং বাস্তবতার ভারসাম্য রক্ষায় নিহিত।
এখন আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তির এই সম্পূর্ণ কাঠামোটি একটি সুনিপুণ কূটনৈতিক ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়; এটি কেবল পদক্ষেপ গ্রহণের বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য ডিজাইন করা একটি অন্তঃসারশূন্য প্রদর্শনী, যখন কি-না গ্রহটি অপরিবর্তনীয় বিপর্যয়ের দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই চুক্তিগুলো শেষ পর্যন্ত অর্থহীন, কারণ এগুলো স্বেচ্ছামূলক, অ-বাধ্যতামূলক ‘অবদানের’ ভিত্তির ওপর নির্মিত, যা জাতীয় স্বার্থের মুখে নিয়মিতভাবে উপেক্ষিত হয়।
সভ্যতার চাদরে মোড়া লোক দেখানো পারস্পরিক চাপ ছাড়া এর কোনো বাস্তব প্রয়োগকারী ব্যবস্থা না থাকায়, এই সিস্টেমটি মৌলিকভাবে ক্ষমতাহীন—এটি কর্পোরেট লবিগুলোর স্বল্পমেয়াদি লোভ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের আবেশের কাছে জিম্মি। আমরা কার্যত শুধু আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতাকেই নথিভুক্ত করছি, আলোচনা এবং নিষ্ক্রিয়তার এক মারাত্মক চক্রে আটকে আছি, যেখানে ধীরে ধীরে অর্থপূর্ণ হস্তক্ষেপের শেষ সুযোগটিও চিরতরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জলবায়ু চুক্তিগুলো সত্যিকারের অর্থপূর্ণ করে তুলতে হলে, এই কাঠামোকে অবশ্যই একটি স্বেচ্ছামূলক ‘ভদ্রলোকের চুক্তি’ থেকে একটি বাধ্যতামূলক আইনি চুক্তিতে রূপান্তরিত হতে হবে, ঠিক যেমনটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় সার্বভৌমত্বের একটি আমূল পুনঃসংজ্ঞায়ন। স্বীকার করে নিতে হবে যে জলবায়ু কোনো ঘরোয়া বিষয় নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক সম্পদ।
একটি অতি-রাষ্ট্রীয় (supranational) সংস্থাকে অবশ্যই হস্তক্ষেপমূলক, স্বাধীন যাচাইকরণ ব্যবস্থা (verification) পরিচালনার ক্ষমতা দিতে হবে। বর্তমানের অবিশ্বস্ত স্ব-প্রতিবেদন বা self-reporting এর যে মডেলটি রয়েছে, এটিকে পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। এছাড়াও, এই অতি-রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অবশ্যই কঠোর, অ-আলোচনাযোগ্য অর্থনৈতিক পরিণতি বা শাস্তির মাধ্যমে সব রাষ্ট্রের সম্মতি কার্যকর করার ক্ষমতা থাকতে হবে, যেমন সর্বজনীন কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (CBAMs), যা অতিরিক্ত মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি (fossil fuel) আমদানিকারকদের শাস্তি দেবে, অথবা এমনকি সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
তদুপরি, বৈষম্যের যে গভীর সমস্যাটি রয়েছে তাও সমাধান করতে হবে। ঐতিহাসিক উচ্চ-কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলো থেকে বাধ্যতামূলক, ক্ষতিপূরণ-ভিত্তিক ‘দূষণকারী কর্তৃক অর্থায়ন’ (polluter pays funding) ব্যবস্থার মাধ্যমে জরিমানা আদায় করতে হবে, যা স্বেচ্ছামূলক ‘ক্ষয়ক্ষতি’ তহবিলকে প্রতিস্থাপন করবে। এই তহবিলের অর্থ গ্লোবাল সাউথের সবুজ রূপান্তর এবং অভিযোজন প্রচেষ্টায় অর্থায়ন করবে।
পরিশেষে যেকোনো অর্থপূর্ণ চুক্তিকে অবশ্যই সমস্যার উৎসে আঘাত হানতে হবে, যার জন্য বিশ্বব্যাপী সব জীবাশ্ম জ্বালানী ভর্তুকি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করার একটি সহজ, বাধ্যতামূলক এবং অ-আলোচনাযোগ্য সময়সীমা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা বর্তমানে দূষণকে গ্রহ রক্ষার চেয়ে বেশি লাভজনক করে রেখেছে।
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়