বর্তমান পৃথিবী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পৃথিবী। মহাকাশ গবেষণার উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে একজন গৃহিণীর আটপৌরে কেনাকাটার তথ্য বিশ্লেষণ, মানুষের স্বভাব ও মনোভাব, এমনকি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার পথরেখা নির্ধারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞানের নবতর এই আবিষ্কার আগামী কয়েক বছরে পৃথিবীতে যে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে যা অনেকের কল্পনাতেই নেই। তবে এই নতুন প্রযুক্তি যে মানুষের জীবনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে তাতে থাকার কথা নয়। এই প্রভাব ও পরিবর্তনের একটি দিক নিশ্চিতভাবেই নেতিবাচক।

মানবসমাজের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধকার প্রমথ চৌধুরী অনেক আগেই বলেছিলেন, স্বাস্থ্য নয় ব্যাধিই সংক্রামক। আর ইন্টারনেট নির্ভর পৃথিবীতে এই সংক্রমণের প্রকোপ খুবই মারাত্মক। শুধুমাত্র একটি ক্লিকেই এই ভাইরাস ছড়াতে পারে মহামারির গতিতে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা অনলাইন অতিমারির যুগে (Infodemic World) ভার্চুয়াল জগতের নিগ্রহ, নিপীড়ন এমনকি সহিংসতা উসকে দেওয়ার হওয়ার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। যা থেকে নারী-পুরুষ-শিশু-বয়োবৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছেন না।

উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় সর্বগ্রাসী এই নিপীড়ন, নিগ্রহ ও সহিংসতার অন্যতম প্রধান আশ্রয় এখন এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অনেক দেশেই যা এরমধ্যেই বিপদসীমা পার করেছে। অলাভজনক দাতব্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডমহাউজের (Freedom House) মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব সমাজের বহু সমস্যার সমাধান সহজ করে দিলেও তৈরি করেছে নতুন বিপদ।

প্রতিষ্ঠানটির মতে, এআই এর কর্তৃত্বপরায়ণ ও সহিংসতাপ্রবণ বহু গোষ্ঠীর কাছে এক ধরনের নিপীড়ক ক্ষমতার (The Repressive Power) উৎস হিসেবে ধরা দিয়েছে। যা অনলাইন পরিসরে তৈরি করতে ভয়ানক নৈরাজ্য (Information disorder)। বাংলাদেশের মতো নিম্নমাধ্যম ও ইন্টারনেট সাক্ষরতার দেশে তৈরি করেছে ভীতিকর এক পরিস্থিতি।

প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিসরে দেখা মিলছে এইআই নির্মিত অবমাননাকর, উসকানিমূলক আধেয়। ডিপফেক (Deepfake) অডিও ভিডিও, ডক্টরড ফটো (Doctored Photos), অপমানমূলক ব্যাঙ্গ (troll) উদ্দেশ্যমূলক নরজরদারী (stalking), সর্বোপরি যৌন হয়রানি সারাবিশ্বের নেটিজেনদের জন্য তৈরি করেছে এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির। ভার্চুয়াল সহিংসতার (Digital Violence) মতো ভয়াবহ বিষয় আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। [ফ্রিডমহাউজ, ২০২৫, অনলাইন]

...সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে ২০২৩ সালে অনলাইন পরিসরে ডিপফেক পর্নোগ্রাফি বেড়েছে ছয় শতাংশ। এর প্রধান শিকার নারীরা হলেও পুরুষ ও শিশুরাও এর বিপদ থেকে বাঁচতে পারছেন না।

অতি সম্প্রতি সাইবার বুলিং রিসার্চ সেন্টার নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ সংক্রান্ত আরও ভয়াবহ চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টুল ব্যবহার করে মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি (substantial psychological and emotional harm) হচ্ছে। বাড়ছে ঘৃণা ছাড়ানো (Hate Speech), যৌন জিম্মিকরণ (Sextortion)-সহ নানা রকম ভীতিকর অপরাধ। উল্লেখ করা ভালো অনেকক্ষেত্রেই এসব অপরাধের প্রধান ও প্রথম শিকার নারী ও শিশু। (সাইবার বুলিং রিসার্চ সেন্টার, ২০২৫, অনলাইন)

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মার্কিন পপ শিল্পী টেইলর সুইফটকে সবার চেনার কথা। অতি সম্প্রতি কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সাথে প্রেমের গুঞ্জন নিয়ে তিনি বেশ আলোচনায় আছেন। মার্কিন এক পপ শিল্পী চলতি বছরের মার্চ মাসে শিকার হয়েছেন এআই নির্মিত নগ্ন ছবির এক ভীতিকর অভিজ্ঞতার।

হঠাৎই তিনি আবিষ্কার করেন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ওয়েবসাইটগুলোয় এইআই নির্মিত নগ্ন ছবি ও ভিডিও দিয়ে প্রচুর আধেয় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যা তার মানসিক শান্তি নষ্টের পাশাপাশি সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। তৈরি করেছে সামাজিক চাপ। এআই-এর নেতিবাচক প্রভাব, চর্চা ও অপরাধমূলক ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করে সিকিউরিটি হিরো নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।

এর সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে ২০২৩ সালে অনলাইন পরিসরে ডিপফেক পর্নোগ্রাফি বেড়েছে ছয় শতাংশ। এর প্রধান শিকার নারীরা হলেও পুরুষ ও শিশুরাও এর বিপদ থেকে বাঁচতে পারছেন না। ওই গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে, মাত্র ২৫ মিনিট সময় ব্যয় করে পুরোপুরি ফ্রি এআই টুল ব্যবহার করে যে কেউ ৬০ সেকেন্ডর নগ্ন অথবা প্রোপাগান্ডামূলক ভিডিও তৈরি করতে পারেন। এছাড়া তাদের গবেষণায় পাওয়া গেছে, মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ভার্চুয়াল পরিসরে এক লাখের বেশি যৌনতাভিত্তিক ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেগুলো এআই দিয়ে তৈরি বা সম্পাদিত। [সিকিউরিটি হিরো, ২০২৫, অনলাইন]

বাংলাদেশও এই ধরনের প্রবণতা বা অপরাধের বাইরে নয়। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর ও স্বল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাক্ষরতার দেশে অনলাইন পরিসরে নিগ্রহ, নিপীড়ন, সহিংসতা এক ভীতিকর বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়েছে। যে প্রবণতাকে আরও সহজ করে দিচ্ছে এআই। একটু দৃষ্টি দিলেই এ সংক্রান্ত ভীতিকর গল্প সামনে হাজির হয়। এখানে উল্লেখ করা ভালো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নারীরা এর প্রধান শিকার।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) [Police Cyber Support for Women - PCSW]-তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার সাইবার পরিসরে সহিংসতার শিকার হয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন এখানে কিন্তু শুধু নারীরাই নন, পুরুষ শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ এর শিকার হচ্ছেন।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের নতুন এক মেরুকরণ শুরু হয়েছে। এখানে বর্তমানে ক্ষমতাসীন হতে বেশ কয়েকটি পক্ষ মরিয়া হয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যে কার্যক্রমের অন্যতম ক্ষেত্র হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিসর।

এই পরিসরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে রীতিমতো প্রশিক্ষিত বাহিনী নিযুক্ত করেছে বিবদমান পক্ষগুলো। যারা নারী, পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তৎপর। যাতে তাদের প্রধান সহায় ও সহযোগী এআই। আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখতে পাচ্ছি কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়া শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একপক্ষ এআই-ভিত্তিক নগ্ন ছবি ও যৌনতার ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছেন নির্বিচারে। এআইকে ভিত্তি করে অপতথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হচ্ছে ফটোকার্ড, সংবাদ বিবরণী ইত্যাদি। সামনে জাতীয় নির্বাচনে এই প্রবণতা যে আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সাইবার পরিসরের নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও অপরাধীদের সাজা নিশ্চিতে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওয়াল্ড ইকোমিক ফোরামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে তারা বেশি দৃষ্টি দিচ্ছে অপরাধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে। প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ডিজিটাল ভিভাইস ব্যবহার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা ফিচার সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি করতে তৎপর।

আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখতে পাচ্ছি কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়া শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একপক্ষ এআই-ভিত্তিক নগ্ন ছবি ও যৌনতার ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছেন নির্বিচারে।

এছাড়া রয়েছে আইনি সুরক্ষার কাঠামো। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এরইমধ্যে সারাবিশ্বে এ সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা প্রণয়নে কাজ করছে। তারা চেষ্টা করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দায়বদ্ধতা বাড়াতে। এছাড়া সারাবিশ্বের নাগরিক আন্দোলনগুলো এ ধারায় যুক্ত করতেও কাজ করছে জাতিসংঘ।

আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি আর আইন যাই হোক না কেন, জেনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে একজন মানুষের জীবন ধ্বংস করতেও প্রতিপক্ষ সামান্য কার্পণ্য বোধ করে না। সাম্প্রতিক সময়েই এমন উদাহরণ অসংখ্য।

এসব ঠেকাতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ খুবই জরুরি, অপরাধীর কঠোর শাস্তি হওয়া জরুরি। এমন বাস্তবতায় নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক থাকা এবং কোনো অপরাধের শিকার হলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়া খুবই কার্যকর হতে পারে।

একথা বলাই বাহুল্য, এআই দ্বারা নির্মিত কোনো আধেয়র মাধ্যমে অপরাধীর কথা মতো কাজ করার চাইতে আইনের আশ্রয় নেওয়া শত গুণ ভালো সিদ্ধান্ত।

সহায়ক:

১। The Repressive Power of Artificial Intelligence, Freedom house 2025, retrieved on 08-11-2025,

https://freedomhouse.org/report/freedom-net/2023/repressive-power-artificial-intelligence

২। Generative AI as a Vector for Harassment and Harm, Cyberbullying Research Center, retrieved on 08-11-2025, https://cyberbullying.org/generative-ai-as-a-vector-for-harassment-and-harm

৩। State of deepfakes, 2023, retrieved on 08-11-2025 , https://www.securityhero.io/state-of-deepfakes/

৪। Tech bros need to realise deepfake porn ruins lives – and the law has to catch up, The Guardian, retrieved on 08-11-2025, https://www.theguardian.com/global-development/2024/mar/01/tech-bros-nonconsensual-sexual-deepfakes-videos-porn-law-taylor-swift

রাহাত মিনহাজ : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়