ছবি : সংগৃহীত

২৩ জুন উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বাহাত্তরতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সাত দশকেরও অধিক সময় ধরে এই রাজনৈতিক দলের ঐতিহাসিক উত্থান-পতনের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস।

১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশভাগ-পূর্ব অখণ্ড ভারতের রাজনীতি ও জনমানসের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া এই রাজনৈতিক দল গঠনের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বাংলার রাজনীতিতে যে ভেদনীতির আগুন জ্বেলেছিল, তাতে ঘি ঢেলে রাজনৈতিক ওম পোহানোর মতলবেই নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগ ও সভাপতিত্বে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর জন্ম নিয়েছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ততদিনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৮৫) কুড়ি বছর পার করে ফেলেছে।

১৯১১ সালে মানুষের প্রতিবাদের মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। ইতিহাসে বলছে— বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে বাংলার মুসলমানরা নিজেদের স্বার্থ ও সত্তা সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারি— এই মুসলমান আসলে ‘অভিজাত শ্রেণির মুসলমান’। সুতরাং বঙ্গভঙ্গ-পরবর্তী সময় থেকে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই, তা দিয়ে বাঙালির আপামর মনস্তত্ত্বের রাজনৈতিক প্রতিবেদন দাঁড় করানো সম্ভব না।

বলে রাখা ভালো, প্রতিষ্ঠার কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে পরোক্ষভাবে প্রমাণ করতে হয় তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে ভারতবাসীর চেয়ে ‘হিন্দু স্বার্থ’ প্রাধান্য পাবে। ফলে মুসলিম স্বার্থের আলোচনা আসতে বাধ্য। এ কারণেই বঙ্গভঙ্গ-পরবর্তী সময় থেকেই একের পর এক মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণকারী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৬৬ সালের (১৮-২০ মার্চ) কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক যাত্রা বন্ধুর হলেও হতাশাব্যঞ্জক ছিল না। এর প্রধান কারণ, রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের সাংগঠনিক কম্পাসটি তৎকালীন জনমনস্তত্ত্বকে অনুসরণ করতে পেরেছিল।

নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি (১৯২৯), নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি (১৯৩৩), কৃষক-প্রজা পার্টি (১৯৩৬) ইত্যাদি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার মূল সুরটিই ছিল বাঙালি মুসলমানের অবস্থার উন্নয়ন। যদিও শিখণ্ডী হিসেবে কৃষক-প্রজা-বর্গাচাষীদের কথাই বলা হতো। তবে বিশ শতকের প্রথম চার দশকে গোটা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক কাঠামোকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ে বিভক্ত করার ব্রিটিশ-প্রযোজিত ষড়যন্ত্র যে সর্বাঙ্গে সফল হয়েছে— এ কথা বলা যাবে না।

কারণ কংগ্রেস কী বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ (১৯০৭) দুটো রাজনৈতিক দলেই প্রগতিশীল ধারার বিকাশ ঘটেছিল। প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনৈতিক ধারা তো ছিলই, তার বাইরেও এ দুটো রাজনৈতিক দলে জাতীয়তাবাদী প্রগতিপন্থী ধারার বিকাশ ঘটে।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক কাঠামো গণমুখিতার প্রশ্নে স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সঙ্গে খাজা পরিবারের আদর্শিক প্রভেদ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরম খাঁ এবং মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় অবাঙালি নেতৃত্ব ছিল খাজা পরিবারের পক্ষে। কিন্তু ইতিহাস তো ক্ষমতানুগ নয়, তার পথ হলো জনতার গভীর হৃদয়— ফলে পাকিস্তান সরকারের পকেট সংগঠন মুসলিম লীগের নানা নির্যাতন-নিপীড়ন সত্ত্বেও আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে প্রায় ৩০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন (২৩ ও ২৪ জুন কর্মী সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল) প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।

আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমানকে (কারাবন্দী অবস্থায়) যুগ্ম-সম্পাদক এবং ইয়ার মোহাম্মদ খানকে নব-প্রতিষ্ঠিত এই দলের কোষাধ্যক্ষ করা হয়।

দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নির্মাণের কাজটি করা হয় ১৯৫৫ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে (২১-২৩ অক্টোবর), যদিও এ সংক্রান্ত আলোচনা প্রতিষ্ঠার চার বছর পর ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনেই উত্থাপন করা হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৬৬ সালের (১৮-২০ মার্চ) কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক যাত্রা বন্ধুর হলেও হতাশাব্যঞ্জক ছিল না। এর প্রধান কারণ, রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের সাংগঠনিক কম্পাসটি তৎকালীন জনমনস্তত্ত্বকে অনুসরণ করতে পেরেছিল। ১৯৬৬ সালের কাউন্সিল থেকেই উত্থাপিত হয় ‘আমাদের বাঁচার দাবী ৬-দফা’ এবং এরমধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাগ্যের সঙ্গে একসঙ্গে যাত্রা শুরু করে বাংলার মানুষ।

এক ন্যুব্জ পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে দলের হাল ধরেন পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১-২০২১—এই সুদীর্ঘকাল তিনি কেবল আওয়ামী লীগকেই নয়, বাংলাদেশকেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন দক্ষতার সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কাউন্সিলটি হয় ১৯৭২ সালের ৭-৮ এপ্রিল। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দলীয় কর্মপদ্ধতির রূপরেখাই ছিল এ কাউন্সিলের মূল আলোচ্য।

১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যার আগ পর্যন্ত ১৯৭৪ সালের ১৮-২০ জানুয়ারি আরেকটি কাউন্সিল হয়েছিল। এই কাউন্সিল অধিবেশনেই দলের সভাপতির পদ থেকে বিদায় গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু।

পঁচাত্তর পরবর্তী বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩-৪ এপ্রিল। দলের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই তখন কারাগারে। তবুও সারাদেশ থেকে প্রায় ১৩০০ কাউন্সিলর ও সম-সংখ্যক ডেলিগেটস এ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন।

তখন বাংলাদেশ যেমন বিপর্যস্ত, দল হিসেবে আওয়ামী লীগও বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের জীবনসঙ্গী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দলের হাল ধরেন। এর মাত্র ১১ মাস পরেই (১৯৭৮ সালের ৩-৫ মার্চ) অনুষ্ঠিত হয় পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশন।

সামরিক শাসনের বীভৎসতা আর অপ-রাজনীতির হল্লায় আওয়ামী লীগের দলীয় ঐক্য তখন হুমকির মুখে। এমনই এক ন্যুব্জ পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে দলের হাল ধরেন পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১-২০২১—এই সুদীর্ঘকাল তিনি কেবল আওয়ামী লীগকেই নয়, বাংলাদেশকেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন দক্ষতার সঙ্গে।

রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মূল বৈশিষ্ট্য হলো— জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের যে ইতিহাস এই দলটির হাত ধরে তৈরি হয়েছিল, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সে ইতিহাসের অনুগামী বা বলা ভালো— এই ইতিহাসমুখীতাই তার রাজনীতির মূল সুর। অন্যদিকে তার দলীয় নীতি, কর্মসূচি ও সাংগঠনিক কাঠামো উদারপন্থী গণতন্ত্রমনা হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তাকে কার্য পরিচালনা করতে হয়েছে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যা দৃশ্যত গণতান্ত্রিক হলেও তার উপাদানগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যহীন সম্পর্ক ও বড় রকমের বৈষম্য বিদ্যমান।

এতদ্সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক যে মূল্যবোধ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই দক্ষিণ এশীয় রাজনৈতিক চেতনায় অন্তর্নিহিত, তা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিকাঠামোতেও নথিভুক্ত। ফলে সাতচল্লিশ-পরবর্তী জটিল রাজনৈতিক অঙ্কে বাঙালি মানসকে যেমন দলটি তার বিকাশের মূল স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে তার রাজনীতি পরিচালনার মূল অবলম্বন হয়ে উঠে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস।

যদিও স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির কার্যক্রমের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা বুঝতে পারি— তার রাজনৈতিক দর্শনটি স্পষ্ট হলেও, তাকে কেন্দ্র করে গন্তব্যে পৌঁছানোর পথটি অমসৃণ। এ কারণেই আওয়ামী লীগের ইতিহাস পড়লে তার নির্ভয় যাত্রার সরণ চিহ্নটাই সবকিছু ছাপিয়ে উঠে আসে।

মারুফ রসূল ।। ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্লগার