ছবি : সংগৃহীত

জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট আলোচনা চলাকালে কয়েকজন সদস্য দেশ পরিচালনায় সরকারের আমলা নির্ভরতার সমালোচনা করেন এবং এ বিষয়ে তাদের ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। গত বছর মে মাসে যখন করোনার প্রকোপ বাড়ে, তখন ৬৪ জেলায় করোনা প্রতিরোধ এবং ত্রাণ সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ৬৪ জন সচিবকে।

বলা বাহুল্য, সংসদ সদস্যরা তাতে খুশি হননি। এ বছর এপ্রিল মাসে আবার একইভাবে ৬৪ সচিবকে একটি করে জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সাংসদরা বক্তব্য রাখেন ২৮ জুন ২০২১।

শুরু করেন জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন ‘এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মানুষ মনে করে আমরা যা দেই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন। অথচ প্রশাসনিক যারা কর্মকর্তা তারা কিন্তু যানই না। যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনি এখন পর্যন্ত যাননি।

একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব, কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’ তিনি আরও স্মরণ করিয়ে দেন যে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবের উপর, এটা খেয়াল রাখতে হবে। এ ধরনের দায়িত্ব আগে সংসদ সদস্যদের দেওয়া হতো, তাও তিনি মনে করিয়ে দেন।

এ বক্তব্যের সূত্র ধরে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সাথে যখন কথা বলেন তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না। রাজনীতির মঞ্চ ব্যবসায়ীরা দখল করেছেন, একথাও বলেন তিনি।

সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী সরকারি কর্মকর্তাদের কঠোর সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, প্রশাসন ঘুষ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এমন কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা ক্ষেত্র নেই যেখানে ঘুষ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করাতে পারবে।

মাননীয় সংসদ সদস্যদের বক্তব্যে বেশ কয়েকটি বিষয়ে তাদের অসন্তোষ, ক্ষোভ উঠে এসেছে। এক এক করে সেগুলোর প্রতিটির দিকে নজর দেওয়া যাক।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সাথে যখন কথা বলেন তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না। রাজনীতির মঞ্চ ব্যবসায়ীরা দখল করেছেন...

বাংলাদেশের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংসদ সদস্যদের সচিবদের উপর স্থান দিয়েছে এবং এটা খুবই স্বাভাবিক। জনপ্রতিনিধি এবং দেশ পরিচালনায় তারাই আইন প্রণয়ন এবং নীতিমালা নির্ধারণ করেন। তবে সরকারি কর্ম সম্পাদন সচিব এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজ, আর আমার মনে হয় না এই দুইয়ের মাঝে কোনো সংঘাত আছে। কোনো সরকারি (বা বেসরকারি) অনুষ্ঠানে অবশ্যই সাংসদরা সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে সম্মানজনক অবস্থান লাভ করবেন।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষমতার বিভাজনের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। সংসদ সদস্যরা দেশের আইন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের মূল কাজ আইন প্রণয়ন, যার ভিত্তিতে দেশ চলবে। তাদের মধ্যে যারা মন্ত্রিসভার সদস্য তারা একইসাথে নির্বাহী বিভাগেরও অংশ। সচিব এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তা কর্মচারীরা নির্বাহী বিভাগের অংশ হিসেবে মন্ত্রীদের নির্দেশ মোতাবেক কর্ম সম্পাদন করবেন এটাই প্রত্যাশিত।

প্রধানমন্ত্রী যে সময় সময় ডিসিদের বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দেন, এটা নির্বাহী বিভাগের স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতির মধ্যেই পড়ে। নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে এধরনের দায়িত্ব বণ্টন প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারভুক্ত। বস্তুত, একদিন পর ২৯ জুন, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী সচিবদের এই দায়িত্ব প্রদানকে ‘প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেছেন।

ঢালাওভাবে শুধু প্রশাসনকে দায়ী করলে চলবে না। ছোটখাটো দুর্নীতি করে কর্মকর্তারা পার পেতে পারেন, কিন্তু বড় বড় দুর্নীতি রাজনৈতিক যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব নয়।

নির্বাহী বিভাগ তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছে কি না সেটা সাংসদরা অবশ্যই নজরদারি করতে পারেন এবং সেজন্য প্রতি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো রয়েছে। এই কমিটিতে তারা নির্বাহী বিভাগের কাজ পর্যালোচনা করে জবাবদিহি চাইতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করতে পারেন। নির্বাহী বিভাগের দৈনন্দিন কার্যনির্বাহে অংশ নেওয়া সাংসদদের দায়িত্ব বলে মনে হয় না।

ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ে বেশ খোলামেলা কথা বলে ফেলেছেন সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী। তার কথায় অবশ্যই গুরুত্ব আছে, আর টিআইবি’র বার্ষিক প্রতিবেদনেও তার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। অন্তত সাব রেজিস্ট্রারের অফিস এবং ভূমি অফিসে শুধুমাত্র সরকারি ফি দিয়ে সেবা পেয়েছে এমন কাউকে আমি দেখিনি। এমনকি সেটি যদি কোনো নিষ্কণ্টক সরকারি প্লটও হয়। তবে কথা হলো, ঢালাওভাবে শুধু প্রশাসনকে দায়ী করলে চলবে না।

ছোটখাটো দুর্নীতি করে কর্মকর্তারা পার পেতে পারেন, কিন্তু বড় বড় দুর্নীতি রাজনৈতিক যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গ এসেছে, জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সদস্যই তো ব্যবসায়ী। ভুলে গেলে চলবে না, যে সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়শই ব্যবসায়িক কাজে সাংসদদের চাপের সম্মুখীন হন এবং সাধারণত সে চাপ খুব ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্তের জন্য নয়। আর রাজনীতিতে যে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বেড়েছে, সে দায় তো প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নয়, রাজনীতিকদেরই।

জনপ্রতিনিধি কিন্তু শুধু সাংসদরাই নন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে যারা নির্বাচিত হন তারাও জনপ্রতিনিধি এবং তারা নির্বাহী বিভাগেরই অন্তর্ভুক্ত। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা অবিরাম উচ্চারিত হয়, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চরমভাবে কেন্দ্রীভূত। কেন্দ্র থেকে এই ক্ষমতার অংশ মাঠপর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের কোনো উদ্যোগ কখনো দেখা যায়নি।

মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সর্বক্ষণ অবলোকন করেন যে, এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই, বরং তারাই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার জন্য কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হন। এমতাবস্থায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার স্বার্থে মাঠপর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানসমূহে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।

জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্যদের গুরুত্ব, সম্মান এবং ক্ষমতার উৎস তাদের জনসম্পৃক্ততা। যেহেতু নির্দিষ্ট সময় পর ভোটের জন্য তাদের জনগণের দুয়ারে হাজির হতে হয়, নির্বাচনী এলাকার জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ ও অবিরাম মিথস্ক্রিয়া তাদের জন্য অপরিহার্য।

সম্প্রতি নির্বাচন ব্যবস্থায় যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে একদিকে যেমন জনগণের গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে প্রশাসনের গুরুত্ব বেড়েছে। আমলাদের বিরুদ্ধে যে কারণে আজ তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তা সৃষ্টিতে এ বিষয়টিও কাজ করেছে কি না, মাননীয় সাংসদরা তা বিবেচনা করে দেখতে পারেন।

মো. তৌহিদ হোসেন ।। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব