গলদটা একদম গোড়ায়। ছেলেবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। তার মানে একদম শিশু মনেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, লেখাপড়া করার আসল উদ্দেশ্য গাড়ি-ঘোড়া কেনার মতো অর্থ উপার্জন। কিন্তু এই ধারণাটা একদম ভুল। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য মোটেই অর্থ উপার্জন নয়, অন্তত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা সেই গাড়ি-ঘোড়ার পেছনেই ছুটি। কোন বিষয়ে পড়লে ভালো চাকরি মিলবে, সেটাই সবার টার্গেট; বিষয়টি পড়তে শিক্ষার্থীর ভালো লাগছে কি না, তা ভাবার সময় নেই কারো।

সত্যিকার অর্থে অর্থ উপার্জনের জন্য লেখাপড়া করার দরকার নেই। অর্থ উপার্জনের হাজারটা উপায় আছে। লেখাপড়া করা উচিত জ্ঞান অর্জনের জন্য, আরও মানবিক মানুষ হওয়ার জন্য। কিন্তু সেই যে ছেলেবেলায় গাড়ি-ঘোড়ার লোভ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় মগজে, অনেকেই তা থেকে আর বের হতে পারেন না। অর্থটাই মুখ্য হয়ে যায়। পরে যতই বলা হোক, অর্থই অনর্থের মূল; সবাই শুনতে পায়, অর্থই সকল ক্ষমতার উৎস।

রফিকুল আমিনের জুম মিটিং এই প্রথম নয়। তার মানে দিনের পর দিন হাসপাতালে বসে তিনি অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা তার এই অবৈধ কাজের সহযোগী, তারা কারা? তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

চারপাশে আমরা যা দেখি তাতে এই ধারণাতে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। টাকা দিয়ে আসলে সবকিছু কেনা যায়। কথায় বলে, টাকায় বাঘের চোখ মেলে। আসলেই তাই। দাম কম বেশি হতে পারে, কিন্তু সবকিছুই যেন বিক্রয়যোগ্য। টাকা থাকলে খুনের মামলার আসামি হলেও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো যায়।

হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েও কারাগারের নামে আরামে হাসপাতালে হাসপাতালে কাটিয়ে দেওয়া যায়। আইন নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। দুই গরিবের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমা চললে দুজনই ধ্বংস হয়ে যায়। ধনী আর গরিবের মধ্যে আইনি লড়াই চললে গরিব ধ্বংস হয়ে যায়। আর দুই ধনীর মধ্যে আইনি লড়াই চললে আইন বদলে যায় বা বিক্রি হয়ে যায়। কাগজে যাই লেখা থাকুক, বাস্তবতা হলো, আইন সবার জন্য সমান নয়। বড়লোকের জন্য আইন একরকম, গরিবের জন্য আরেকরকম। ধনাঢ্য ও প্রভাবশালীরা নানাভাবে আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যায়।

অতীতেও আমরা দেখেছি, প্রভাবশালী আসামিদের কাউকে যদি শেষ পর্যন্ত কারাগারে যেতেই হয়, তারা দ্রুত ‘অসুস্থ’ হয়ে যান বা অসুস্থ হওয়ার ভান করেন এবং কারাগার থেকে হাসপাতালে চলে যান। তারপর চলে আয়েশি জীবন। গণমাধ্যমে লেখালেখি হলে তাদের কাউকে কাউকে কারাগারে ফিরতে হয় বটে, কিন্তু আলোচনা থেমে গেলেই আবার হাসপাতাল।

ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন ২০১২ সাল থেকে কারাগারে আছেন। কিন্তু গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ের বেশিটাই রফিকুল আমিন কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। যেমন এই দফায়, রফিকুল আমিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন প্রায় তিনমাস। তবে এবার তিনি সব সীমা লঙ্ঘন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে বসেই তিনি ঘণ্টাব্যাপী জুম মিটিং করেছেন, নতুন করে ব্যবসার পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন। তার মানে আরও কিছু মানুষকে নিঃস্ব করার পরিকল্পনা হচ্ছে কারাগারে বসেই।

সংবাদ প্রচারের পর তাকে আবার কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার মানে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হলেই আসামি সুস্থ হয়ে যান। সেই ডাক্তারদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত, যাদের পরামর্শে এই আসামিরা কারাগারে না থেকে হাসপাতালে থাকার সুযোগ পান। কারাগারে বসে রফিকুল আমিনের জুম মিটিং-এর খবরে এখন তোলপাড়। সংশ্লিষ্ট কারারক্ষীদের বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, রফিকুল আমিনের জুম মিটিং এই প্রথম নয়। তার মানে দিনের পর দিন হাসপাতালে বসে তিনি অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা তার এই অবৈধ কাজের সহযোগী, তারা কারা? তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। চিরতরে বন্ধ করতে হবে ভান করে অসুস্থ হওয়া আসামিদের হাসপাতালে থাকা এবং হাসপাতালে থেকে বাইরের সাথে অবাধ যোগাযোগ।

রফিকুল আমিনের বিরুদ্ধে চার হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অঙ্কটা ঠিকই পড়েছেন—চার হাজার কোটি টাকা! এই টাকা কিন্তু একদম সাধারণ মানুষের। প্রতারণা করে, লোভ দেখিয়ে তিনি মানুষের টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছেন। পথে বসিয়েছেন লাখো মানুষকে।

রফিকুল আমিনের বিরুদ্ধে চার হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অঙ্কটা ঠিকই পড়েছেন—চার হাজার কোটি টাকা! এই টাকা কিন্তু একদম সাধারণ মানুষের। প্রতারণা করে, লোভ দেখিয়ে তিনি মানুষের টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছেন। পথে বসিয়েছেন লাখো মানুষকে।

রফিকুল আমিন নয় বছর ধরে আয়েশি কারাগারে আছেন বটে, কিন্তু নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর তাতে কোনো লাভ হয়নি। ডেসটিনির সম্পদ এখন পুলিশের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু বছরের পর বছর হাজার কোটি দেখভাল করা পুলিশের কাজ নয়, সেই দক্ষতাও তাদের নেই। তাই সাধারণ মানুষের অর্থে গড়া ডেসটিনির সাম্রাজ্য এখন কাকে-বকে খাচ্ছে।

ডেসটিনি সবচেয়ে বড়, তবে ডেসটিনিই বাংলাদেশের প্রথম হায় হায় কোম্পানি নয়। মানুষের লোভকে পুঁজি করে এই কোম্পানিগুলো নানাভাবে মানুষকে নিঃস্ব করে। শুরুতেই যে বলেছি, ছেলেবেলায় মানুষকে গাড়ি-ঘোড়া চড়ার লোভে লেখাপড়া করতে বলা হয়। এই যে ছেলেবেলায় তাকে লোভ শেখানো হয়, এটা তার অস্থিমজ্জায় মিশে যায়। তাই যেখানেই ফাঁকতালে টাকা আয়ের সুযোগ দেখে, সেখানেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে।

দেশের বাইরে গেলে মানুষ যতটা পরিশ্রম করে, দেশে ততটা করতে চায় না। সবাই চায় শর্টকাটে বড়লোক হতে। শুরুতে দুয়েকজন হয়তো হয়ও। তাই দেখে পতঙ্গের মতো ছুটে আসে আরও অনেকে। তারপর সবাই লোভের আগুনে পুড়ে মরে। যেকোনো ব্যবসা বা বিনিয়োগের আগে মানুষের বোঝা উচিত, যারা অস্বাভাবিক লাভের লোভ দেখাচ্ছে, তারা সেটা কোত্থেকে দেবে? এইটুকু বিবেচনা থাকে না বলে আমরা সবাই নিঃস্ব হই।

এমএলএম কোম্পানিগুলোর পিরামিড মার্কেটি-এ শুরুতে কিছু লোক লাভ পায়। তারপর ধসে পরে বালির বাঁধ। নতুনের টাকায় পুরনোকে লাভ দেয়। একসময় যখন নতুন মক্কেল ফুরিয়ে যায়, তখন লাভও ফুরিয়ে যায়। পুঁজিবাজার চাঙ্গা দেখলেই কিছু মানুষ কিছু না বুঝেই সর্বস্ব নিয়ে আসে। একসময় যখন লোভের বেলুন ফুটো হয়ে যায়, তখন সরকারকে গালাগাল করে। বিদেশ থেকে ‘বন্ধু’র পাঠানো দামি উপহার ছুটাতে প্রতারকদের লাখ লাখ টাকা দিয়ে দেওয়ার উদাহরণও কম নয়।

আমাদের বুঝতে হবে জীবনের কোনো শর্টকাট নেই, অস্বাভাবিক লাভেরও কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তবে সেই লোভী মানুষগুলোর দায় যেমন আছে, দায় আছে সরকারেরও। ডেসটিনি তো হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠেনি বা একদিনে চার হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়নি।

ডেসটিনি মানুষের পকেট কেটে চার হাজার কোটি টাকা নেওয়া পর্যন্ত সরকার অপেক্ষা করল কেন? তবে আমাদের গোড়াটা আগে ঠিক করতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে নিছক অর্থ উপার্জন করা নয়, জীবনের আরও বৃহত্তর লক্ষ্য আছে। আর টাকা থাকলেই সব সম্ভব, এই ধারণাটা যতদিন না বদলাবে, ততদিন মানুষ অর্থের পেছনেই ছুটবে।

চার হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়া রফিকুল আমিন যদি দিনের পর দিন হাসপাতালে কাটাতে পারেন, কারাগারে বসে ঘণ্টাব্যাপী জুম মিটিং করতে পারেন, তাহলে তো মানুষ অর্থের পেছনেই ছুটবে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, আইন ধনী-গরিব সবার জন্য সমান। অর্থ দিয়ে আইন কেনা যায় না। নিশ্চিত করতে হবে, ডেসটিনি হোক আর যেই হোক, প্রতারণায় মানুষকে নিঃস্ব করার সুযোগ কেউ পাবে না, তাহলেই মানুষ আশ্বস্ত হবে। আর দ্রুত রফিকুল আমিনের মামলার নিষ্পত্তি করে, তাকে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে সবাই সাবধান থাকে। যাতে বুঝে সরকারের বা জনগণের টাকা মেরে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি ডেসটিনির সম্পদের একটা সুরাহা করতে হবে, যাতে প্রতারিত মানুষগুলো তাদের অর্থ ফেরত পায়।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ