জেট ফুয়েলের দাম বাড়ানো হয়েছে। আট মাসে সাতবার মূল্য বৃদ্ধি। লিটার প্রতি জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধির এই অতিরিক্ত অর্থ এয়ারলাইন্সগুলো কোথা থেকে সমন্বয় করবে? মনোপলি ব্যবসা করলেই ভোক্তার সুবিধা-অসুবিধা দেখা যাবে না তা কি করে হয়? একটি ইন্ডাস্ট্রি আজ ধ্বংসের কিনারায়।

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে সারাবিশ্ব আজ স্তব্ধ হয়ে আছে। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি আজ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সহসা এ ক্ষতি থেকে উত্তরণের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

করোনাভাইরাসের প্রভাবের ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে এ ক্ষতিকে আরও বেশি বিপর্যস্ত করছে জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধি, অতিরিক্ত অ্যারোনটিক্যাল ও নন অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, সাথে করোনাকালে যুক্ত হওয়া বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ও সিকিউরিটি ফি ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিকে করোনাভাইরাসের কারণে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আর অন্যদিকে এভিয়েশনের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ যাত্রী স্বল্পতা।

করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়লেই এয়ারলাইন্সের উপর খড়গ নেমে আসে। করোনার শুরু থেকেই এয়ারলাইন্সের অপারেশন, থাকা না থাকার দোলাচলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কখনো নিজ দেশের কর্তৃপক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা, আবার অন্য দেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা, কখনো ৫০ শতাংশ যাত্রী ধারণের অনুমতি আবার কখনো ৭০ শতাংশ। এর মাঝে রয়েছে করোনাকালে এয়ারলাইন্স ভ্রমণের নানা রকম স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক নির্দেশনা। সব নির্দেশনার মাঝেই এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ এভিয়েশন তথা বিশ্ব এভিয়েশনে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স শৈশবকাল অতিক্রম করছে। শুরু থেকে যাত্রীদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের আকাশপথকে সুদৃঢ় করার জন্য সারাদেশের মানুষকে সহজ সংযোগ স্থাপনে কাজ করে যাচ্ছে ইউএস-বাংলা।

প্রায় ১৫ মিলিয়ন প্রবাসী রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এভিয়েশনের মার্কেট হিসেবে বড় মার্কেট রয়েছে আমাদের দেশে। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের সব বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো এ দেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে, অনেক এয়ারলাইন্স নতুন করে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য উৎসাহ দেখিয়েছে। এই আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের প্রায় ৭০ শতাংশই বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো দখল করে আছে। আমাদের ব্যবসায়িক কিংবা পলিসিগত দুর্বলতার জন্য মার্কেট শেয়ারের বাকি অংশও চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আন্তর্জাতিক রুটে বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাথে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে।

করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়লেই এয়ারলাইন্সের উপর খড়গ নেমে আসে। করোনার শুরু থেকেই এয়ারলাইন্সের অপারেশন, থাকা না থাকার দোলাচলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কখনো নিজ দেশের কর্তৃপক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা, আবার অন্য দেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা...

বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি জাতীয় বিমান সংস্থাও। একটি এয়ারলাইন্সের যেকোনো গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য যে পরিচালন ব্যয় হয় তার প্রায় ৪০ শতাংশই ফুয়েল খরচ। যা প্রতিযোগী এয়ারলাইন্সগুলোর চেয়ে বেশি বহন করতে হয় দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোকে। যার কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর তুলনায় দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারছে না।

বাংলাদেশের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির বিগত দিনের ইতিহাস অনেকটাই ব্যর্থতার ইতিহাসে ভরপুর। মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এমনকি ইউরোপের অন্যতম গন্তব্য লন্ডনসহ নানা রুটে বিচরণকারী এয়ারলাইন্সগুলো যেমন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, জিএমজি এয়ারলাইন্স, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। সাথে বেস্ট এয়ার, এভিয়ানা এয়ারওয়েজ কিংবা এয়ার পারাবাত, অ্যারো বেঙ্গল। সাউথ এশিয়া এয়ারওয়েজ, নেপচুন এয়ার, এপিক এয়ার কিংবা টিএসি এভিয়েশন, এরিস্টোক্রাট, রূপসী বাংলা এয়ারলাইন্সসহ আরও বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা সাজিয়েছিল কিন্তু শুরুতেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাদের।

ব্যর্থতার ইতিহাসের মধ্যে সফলতার গল্প শোনানোর জন্য বর্তমান প্রজন্মের এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স আর নভোএয়ার জাতীয় বিমান সংস্থার সাথে যাত্রীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ব্যর্থতার ইতিহাসে যাত্রী এয়ারলাইন্সের জন্য গত পঁচিশ বছরে এয়ারক্রাফট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হ্যাঙ্গার সুবিধা না পাওয়া অন্যতম। বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যর্থতার ইতিহাস লিখতে গেলে হ্যাঙ্গার সুবিধার কথা অবধারিতভাবে চলে আসে। সেখানে পূর্বের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা উল্লেখ করার মতো। বর্তমান সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর জন্য হ্যাঙ্গার সুবিধা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করছে, যা সহযোগিতার নিদর্শন হয়ে থাকবে।

বর্তমানে পরিচালিত এয়ারলাইন্সগুলো যদি ব্যবসায় টিকে থাকতে না পারে তবে এই এভিয়েশন মার্কেট চলে যাবে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে, যা বাংলাদেশের এভিয়েশনের জন্য হবে চরম ব্যর্থতার।

বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এয়ারলাইন্সের অপারেশন খরচের বৃহদাংশ দিতে হয় জেট ফুয়েলের জন্য। সেখানে বর্তমান অবস্থা বিবেচনা না করে নিজেদের ব্যবসার কথা মাথায় রেখে মূল্য নির্ধারণ করলে ভোক্তার অধিকারও খর্ব হয়। এ ব্যাপারে পদ্মা অয়েল কোম্পানি আরও যত্নশীল ভূমিকা পালন করলে এয়ারলাইন্সগুলো বিশ্ব এভিয়েশনের অসহনীয় সময়ে টিকে থাকার সুযোগ পাবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রুটের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রুটের জেট ফুয়েলের মূল্য সমন্বয় করা খুবই জরুরি।

প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের জন্য আন্তর্জাতিক রুটের থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে প্রায় ১৩ টাকা বেশি খরচ করতে হয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই অতিরিক্ত খরচ অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীকেই বহন করতে হয়।

এভিয়েশন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যেভাবে এগিয়ে আসা উচিত গত পঁচিশ বছরে সেইভাবে এগিয়ে আসেনি। বর্তমানে এই দুর্বিষহ অবস্থায় যদি সরকার এগিয়ে না আসে তবে বাংলাদেশের এভিয়েশন সেক্টরের ব্যর্থতার ইতিহাস আরও দীর্ঘায়িত হবে। নতুন করে কেউ এই সেক্টরে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে না। জিএমজি এয়ারলাইন্স ১৪ বছর, ইউনাইটেড ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ১০ বছর করে ফ্লাইট পরিচালনা করে বন্ধ হয়ে যায়, নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য যা অশনিসংকেত।

বর্তমানে পরিচালিত এয়ারলাইন্সগুলো যদি ব্যবসায় টিকে থাকতে না পারে তবে এই এভিয়েশন মার্কেট চলে যাবে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে, যা বাংলাদেশের এভিয়েশনের জন্য হবে চরম ব্যর্থতার।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার কিংবা বাংলাদেশ বিমানের উপর অনেকটা নির্ভর করে আছে শত শত ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর, বিভিন্ন মানের তারকা হোটেল। আজ প্রায় সব বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একটু কি ভেবে দেখবেন, এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা কী অবস্থায় আছেন? লক্ষ লক্ষ কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আর্থিক অভাব অনটনে নিদারুণ দিনাতিপাত কি কারো দেখার সুযোগ আছে?

সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঠিক সিদ্ধান্ত এয়ারলাইন্সগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। তাহলে শত শত ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর, হোটেলগুলোর বিনিয়োগকারীরা বেঁচে যাবে, লাখ লাখ কর্মচারী বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। এখন দেখার বিষয় সিদ্ধান্তগুলো সঠিক হবে কি না? সঠিক সিদ্ধান্ত দেখার প্রত্যাশায়।

মো. কামরুল ইসলাম ।। মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স