ঈদ মানে আনন্দ; কিন্তু এবারের ঈদ আনন্দের নয়—উদ্বেগের, ভয়ের। বাংলাদেশে করোনা মহামারি যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তাতে এবারের ঈদে আনন্দ করতে গেলে আপনার এবং আপনার প্রিয়জনের জীবন বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু এই বোধ, এই উপলব্ধি আমাদের হচ্ছে না, আমরা তাই নিয়ম মানছি না, নিষেধ মানছি না, বিধিবিধান কিছুই মানছি না। সরকার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে শুরু করে সচেতন মানুষের আশঙ্কা, সামনে চরম দুঃসময় অপেক্ষা করছে আমাদের, পুরো বাংলাদেশের।

গত বছর মার্চে দেশে করোনা মহামারির শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ছিল অবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার অনাগ্রহ। এসব ব্যাপারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বা বাধ্য করতেও সরকারের আন্তরিকতার অভাব ছিল বলে অনেকে মনে করেন। নাকে মুখে মাস্ক পরার মতো একটা সাধারণ বিষয়ও আমরা দেড় বছরেও দেশের মানুষকে শেখাতে পারিনি, তাদের অভ্যাস করাতে পারিনি, এমনকি বোঝাতেও পারিনি যে বাইরে গেলে মাস্ক পরা কতটা জরুরি।

সরকার এর মধ্যে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুবার সাধারণ ছুটি, বিধিনিষেধ, লকডাউন বা এরকম নানা কিছু ঘোষণা করেছে। কিন্তু এর একটিও দুই-তিনদিনের বেশি কার্যকর ছিল না। দোকান বন্ধ কেন বলে দোকান মালিকরা স্লোগান দিলে সরকার দোকান খুলে দিয়েছে, রমজানের ইফতারি বিক্রির অনুমতি দিয়েছে।

বাস বন্ধ কেন? জবাব চাই বলে পরিবহন মালিক এবং শ্রমিকরা চিৎকার করলে সরকার বাস চালু করে দিয়েছে। অর্ধেক লোক নিয়ে দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হবে—এমন নিয়ম করে দিলেও ভাড়াটা বাড়িতি নিয়েছে ঠিকই, অর্ধেক যাত্রী কেউ নেয়নি।

নাকে মুখে মাস্ক পরার মতো একটা সাধারণ বিষয়ও আমরা দেড় বছরেও দেশের মানুষকে শেখাতে পারিনি, তাদের অভ্যাস করাতে পারিনি, এমনকি বোঝাতেও পারিনি যে বাইরে গেলে মাস্ক পরা কতটা জরুরি।

গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ রাখার হুকুম দিলে বিজিএমই বলেছে, বাংলাদেশ নিঃস্ব হয়ে যাবে, ৫০ বছরের সকল অর্জন এক সপ্তাহে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এক-দুই সপ্তাহ কারখানা বন্ধ রাখলে তারা কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারবে না। অথচ এরা নাকি দেশের ৮০ শতাংশ রপ্তানি আয় করে। তাদের দাবির মুখে সরকার গার্মেন্টস খুলে দিতে বাধ্য হয়।

সরকার যখন সকল সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি অফিস বন্ধ রাখতে বলে, তখনো অধিকাংশ অফিস চালু থাকে। লকডাউনের মধ্যেও যানজটে আটকা পড়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাই লকডাউন বা বিধিনিষেধ কতটা কাজে আসছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বলছিলাম ঈদের কথা। ঈদকে সামনে রেখে কোরবানির পশু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনায়, অর্থনীতি সচল রাখার স্বার্থে, জীবন ও জীবিকার সমন্বয় সাধনের জন্যে সরকার এমন এক সময় লকডাউন বা বিধিনিষেধ তুলে নিল (কাগজে কলমে শিথিল বলা হলেও বাস্তবে তা প্রত্যাহারই) যখন দেশে করোনায় মৃত্যু আর সংক্রমণের রেকর্ড ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলছে।

শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ, প্রতিদিন মারা যাচ্ছে দুইশ থেকে প্রায় আড়াইশ জন। এমন সময় লকডাউন তুলে দেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল কোরবানির পশুর হাট। কিন্তু হাটে হাটে ঘুরছেন এমন লোকজন বলছেন, এবার কোরবানির হাটে পশুর সংখ্যা যতটা বেশি, মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। নিয়ম মানার কোনো বালাই নেই গরুর হাটে। এমনকি রাজধানীতে ইজারা দেওয়া ১৯টি জায়গার বাইরেও বসছে পশুর হাট, অলিতে গলিতে বসছে ছাগলের ভ্রাম্যমাণ হাট। বিক্রেতাদের দোষ দিয়ে কি হবে, শহরের শিক্ষিত সচেতন ক্রেতারাও গরুর হাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাস্ক ছাড়া। হাটে হাটে করোনার রোগী শনাক্ত হচ্ছে, নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বয়স্করা হাটে যাচ্ছেন, যারা টিকা নেননি তারা হাটে যাচ্ছেন, এমনকি শিশুদের সাথে নিয়েও যাচ্ছেন অনেকে। মোটকথা, স্বাস্থ্যবিধি বলে যে কথাটা সরকার এবং গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে বাস্তবে তার প্রয়োগ কোথাও নেই।

ফেরিঘাটের কথাও বলা দরকার। একেকটি ফেরি যেন একেকটি করোনা প্রজনন কেন্দ্র। কোনো রকম নিয়মনীতি বা দূরত্বের বালাই নেই। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে মানুষ গ্রামে যাচ্ছেন, আবার ঈদের পরে তারা সবাই গ্রাম থেকে ফিরবেন। ঢাকার করোনাভাইরাসকে তারা নিয়ে যাচ্ছেন গ্রামে, আবার গ্রামের ভাইরাসকে নিয়ে আসবেন ঢাকায়। অর্থাৎ পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়বে করোনার আরও ভয়াবহতা।

বিক্রেতাদের দোষ দিয়ে কি হবে, শহরের শিক্ষিত সচেতন ক্রেতারাও গরুর হাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাস্ক ছাড়া। হাটে হাটে করোনার রোগী শনাক্ত হচ্ছে, নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বয়স্করা হাটে যাচ্ছেন, যারা টিকা নেননি তারা হাটে যাচ্ছেন, এমনকি শিশুদের সাথে নিয়েও যাচ্ছেন অনেকে।

ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে বলা হচ্ছে এযাবৎকালের সবচেয়ে বেশি বিধ্বংসী করোনাভাইরাসের রূপ। সীমান্ত বন্ধ করার পরেও বৈধ-অবৈধ পথে যেসব মানুষ ভারত থেকে দেশে এসেছেন, তাদের মাধ্যমেই দেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে।

প্রথমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা যশোর, খুলনা অঞ্চলে এই ভাইরাস ছড়ালেও এখন তা বিস্তৃত হয়েছে সারাদেশে। এবারের এই ঈদ যাত্রার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বাদবাকি সকল এলাকায়। তাই সামনে কী অপেক্ষা করছে তা ভাবা আসলেই কষ্টকর।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, রোগী আরও বাড়লে তাদের চিকিৎসা করার সামর্থ্য আমাদের হাসপাতালগুলোর নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে গত দেড় বছরে করোনাভাইরাস নিয়ে বহু হাস্যকর কথা তিনি বলেছেন, কিন্তু তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম।

প্রধানমন্ত্রী সারাদেশের সকল জেলা হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেও এই দেড় বছরেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা পারেনি। এমনকি গত বছরের বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থও পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ নেই, অক্সিজেন নেই, ঢাকার হাসপাতালে জায়গা নেই। এই অবস্থায় আরও রোগী বাড়লে কি হবে তা কল্পনা করে শিউরে ওঠা ছাড়া কিছু করার নেই।

আশার কথা হলো, মাঝে দুই-তিন মাস টিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেই অনিশ্চয়তা কেটেছে। আবার সারাদেশে শুরু হয়েছে গণটিকাদান কর্মসূচি। এখন দ্রুত যত বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যায়, ততই আমরা মুক্ত থাকতে পারবো করোনার বিপদ থেকে। তবে যতদিন পর্যন্ত টিকা দেওয়া না হচ্ছে ততদিন স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।

স্বাস্থ্যবিধি মানে, বারবার হাত পরিষ্কার করা, নাকে মুখে হাত না দেওয়া, বাইরে গেলে মাস্ক পরা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। আসলে পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে কারো অপেক্ষায় না থেকে যার যার সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে।

জ. ই. মামুন ।। প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন বাংলা