আমি তখন ক্লাস ফোরে। বাবা ছিলেন পুলিশের যশোর জেলার গোয়েন্দা কর্মকর্তা। এক রাতে বাবার টেলিফোনটা বারবার বেজে উঠছিল। মায়ের বিছানায় আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় টেলিফোন আর বাবার কণ্ঠের আওয়াজে। একবার ঘুম ঘুম চোখে পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি বাবা কোথাও কথা বলছেন, খুব চিন্তিত স্বরে। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি কিন্তু ঘুম আসে না।

ঢাকায় কথা বলছেন বাবা। সে সময় ছিল ট্র্যাঙ্ক কল লাইন। যশোর কিংবা জেলা সদর থেকে টেলিফোনে ঢাকায় কথা বলতে হতো সেই লাইনে। কথা বলতে গেলে কোনো কোনো সময় এত উচ্চস্বরে কথা বলতে হতো যে, ঘরের কথা শুনতে পেত পুরো পাড়া।

তেমন করেই পাশের ঘরে আমি শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। পূর্ব পাকিস্তানের এক ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতা। খুলনায় এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার পরপরই গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান। কিন্তু খুলনা পুলিশে গোয়েন্দারা তাকে খুলনায় খুঁজে পাচ্ছেন না।

বঙ্গবন্ধু তখন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে ডেঞ্জার ম্যান। খুলনা থেকে বঙ্গবন্ধু ঢাকা যাবে সড়ক পথে। সে খবর জানতো গোয়েন্দারা। আর ঢাকার পথ হলো যশোরের উপর দিয়ে গাড়িতে। ওদিকে খুলনা পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে। কোথাও নেই তার টয়োটা কারটি। কারটির সন্ধান পাওয়া গেল যশোরে। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান সাহেবের বাসার সামনে পার্ক করা গাড়িটির নাম্বার প্লেট মিলে গেল সেই কারটির।

১৯৬৫ সালে সেই রাতেই তার নাম জানতে পারি আমি, তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...

গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে বঙ্গবন্ধু খুলনা থেকে ঢাকার পথে রাত্রি যাপন করবেন যশোরে। ততক্ষণে যশোর আর খুলনা গোয়েন্দা বিভাগের ফিল্ড আর উচ্চ পর্যায়ের অফিসারদের আরাম হারাম করে তুলেছিলেন রাজনীতির সেই ডেঞ্জার ম্যান বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর টয়োটা কারের সন্ধান পেলেও বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন রাত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্রামের কোনো ব্যাঘাত করা যাবে না। তিনি যেন বিশ্রাম নিতে পারেন সে কারণে আপাতত গ্রেফতার নয়।

ভোর হলো। সকালে নাস্তা করে বঙ্গবন্ধু বিদায় নিলেন অ্যাডভোকেট মশিউর রহমানের কাছ থেকে। তিনি যখন ঢাকার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েছেন তখনই তার গতিরোধ করল যশোরের গোয়েন্দারা। বঙ্গবন্ধু গোয়েন্দাদের গতিরোধেই বুঝে ফেলেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সেই গ্রেফতারই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেওয়া হয় ‘আগরতলা মামলা’। ১৯৬৫ সালে সেই রাতেই তার নাম জানতে পারি আমি, তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পর সাজানো মিথ্যা মামলায় তার বিচার শুরু হয় আর আমরা স্কুল থেকে বাসায় যাওয়া পথে দেখি উৎসুক নগরবাসী দল বেঁধে দেয়ালে সেঁটে থাকা দৈনিক ইত্তেফাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র (মিথ্যা) মামলার শুনানি পড়তে ভিড় করছেন। আমিও সেই ভিড়ে বড়দের মাঝে উঁকি দেই দেয়ালে, কিন্তু ছোট হওয়ায় চোখের দৃষ্টি ছিল না পড়ার। সেই প্রথম আমার বঙ্গবন্ধুকে চেনার শুরু।

১৯৭১ সালে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানে আমিও উত্তাল হয়ে উঠি শ্লোগানে, মিছিলে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আমরা তখন আজিমপুর কলোনির বাসিন্দা। বাবা মাত্র ৪২/সি ফ্ল্যাটটি তার নামে বরাদ্দ পেয়েছেন। আমরা মালিবাগ এলাকা ছেড়ে এসেছি সেইসময়।

বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে স্বাধীনতার দিকে এগোচ্ছেন। সাড়া দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলেছেন। কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিলে তিলে বঙ্গবন্ধু দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভেতরে আত্ম সম্মানবোধ, অধিকার আর ন্যায্য পাওনা জাগ্রত করে তুলেছেন।

আম্মা আরও কজনা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে গেলেন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সেই ৭ মার্চে। আমরা আজিমপুর ছাপরা মসজিদের সামনে একটা মুদি দোকানের সামনে ভিড় জমালাম রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনব বলে। কিন্তু অল্প সময় পরে আমরা দেখলাম রেডিও পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা প্রচার বন্ধ করে দিল।

জনসভার পর মা ফিরলেন বেশ পরে। বাড়ি ফিরেছেন সেই রেসকোর্স হাজারো জনতার সাথে হেঁটে হেঁটে। উদ্বিগ্ন আমরা ছেঁকে ধরলাম আম্মাকে। আম্মা বললেন, বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে’, আর বলেছেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে’। আম্মার কথা শুনে আমাদের মুখ শুকালো! আমি কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলাম, আচ্ছা আম্মা পাকিস্তানিদের তো বড় বড় ফাইটার প্লেন আছে, কামান আছে, কত্ত বড় বড় রাইফেল আছে আর পাকিস্তানি মিলিটারিরা যে অনেক উঁচা লম্বা আর ইয়া বড় বড় মোচ আর আমরা বাঙালিরা তো সব পুচকা ছোট ছোট...

বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে স্বাধীনতার দিকে এগোচ্ছেন। সাড়া দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলেছেন। কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিলে তিলে বঙ্গবন্ধু দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভেতরে আত্ম সম্মানবোধ, অধিকার আর ন্যায্য পাওনা জাগ্রত করে তুলেছেন।

আম্মা আমার মাথায় হাত রাখলেন, বললেন, ‘তাতে কি, আমাদের যে বঙ্গবন্ধু আছে!’

আমার চোখের সামনে বিশাল এক বঙ্গবন্ধু এসে দাঁড়াল। আমি আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখার চেষ্টা করি। দেখি বিশাল আকাশের সমান উঁচু এক মানুষ। পাকিস্তানি ফাইটার প্লেন আর ট্যাংকের সামনে পথ আগলে তর্জনী উঁচিয়ে বলছেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর …! আমি হাত তালি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, জয় বাংলা!

বঙ্গবন্ধুর সেই জ্বালাময়ী ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই বাঙালির ঘরে ঘরে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। আমরা ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং জমায়েতে যোগ দিব কিন্তু আমার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ অনেক দূরে। আজিমপুর কলোনির শেষ প্রান্তে লালবাগ ঘেঁষা আমাদের ৪২ নম্বার বিল্ডিং। এতটা পথ!

খবর পেলাম ছাত্রলীগ পলাশীর শেরে বাংলা মাঠে জয় বাংলা বাহিনী ট্রেনিং শুরু করবে। বন্ধু মাহফুজ আলী টুকু বলল, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, এখন ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্রলীগ বলে কিছু নাই। তুমি ছাত্রলীগের ‘ জয় বাংলায়’ ঢুকে পড়ো।’

আমি ঢুকে পড়লাম জয় বাংলায়! আমাদের কমান্ডার হেলালুর রহমান চিশতী, যিনি ছিলেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা। তিনি আমাদের নাম এন্ট্রি করতে লাইনে দাঁড় করালেন। আমার দুরুদুরু বুক। হেলাল ভাই বললেন, ‘নাম কি?’ পাভেল বলতেই আমাকে ভর্তি করে ফেললেন।

আমরা জনা শ’তিনেক কিশোর যুবককে শেখানো হলো গেরিলা যুদ্ধের কৌশল-হিট অ্যান্ড রান, মলোটভ ককটেল ছোড়া, ব্যারিকেড দিয়ে পাকিস্তানি শত্রুর ওপর হামলা আর অস্ত্র কেড়ে নেওয়া।

আমরা জয় বাংলা বাহিনী পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলাম ২৩ মার্চ। আমরা ‘জয় বাংলা’ বলে স্বাধীন বাংলার পতাকা হাতে ছুটলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পথে। সেই আমি ১৫ বছরের এক কিশোর দীপ্ত পায়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সামনে আসতেই আমাদের কমান্ডার আওয়াজ তুললেন, ‘জয় বাংলা বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে সালাম জানাবে, সালাম জানা!’

আমরা বুক টান করে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালামের ভঙ্গিতে ডাইনে তাকিয়ে দেখি লোহার গেট ধরে দাঁড়িয়ে আমাদের বঙ্গবন্ধু!  সালামের প্রতি উত্তরে তিনি সালাম জানাচ্ছেন আমাদেরই। সেই আমার প্রথম দেখা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।

পাভেল রহমান ।। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য