২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হলো, ‘শূন্য ম্যালেরিয়া লক্ষ্যে পৌঁছানো’। স্যার রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয়, অ্যানোফিলিস মশাই ম্যালেরিয়া রোগের বাহক। তার আগ পর্যন্ত, মশা এবং মারাত্মক রোগের মধ্যে এই সম্পর্কের ব্যাপারে বিশ্ব চূড়ান্তভাবে অন্ধকারে ছিল। তার সম্মানে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন দিবসটি পালন করা শুরু করে। এরপর থেকে পৃথিবীর অনেক দেশেই এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

করোনা মহামারির সময়ে আমরা বিশ্ব মশা দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি, যখন ডেঙ্গু মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে গড়ে প্রায় আড়াইশো মানুষ। মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে জনগণের সম্পৃক্ততা বেশি জরুরি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু হয়েছিল ২০১৯ সালে। জুন, জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর এই চার মাস ডেঙ্গুর মৌসুম। এ সময়টায় যদি আমরা সতর্ক থাকি তাহলেই ডেঙ্গু থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

এডিস ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গু বিস্তারে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে। আরেকটি প্রজাতি এডিস এলবোপিকটাস যাকে এশিয়ান টাইগার মশা বলা হয়। এটি বন্য বা জংলি বা গ্রামের মশা। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই এ মশাটি রয়েছে।

ডেঙ্গু এডিস মশা বাহিত একটি ভাইরাস ঘটিত জ্বর রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি স্ট্রেইন (ডেন-১, ২, ৩ ও ডেন-৪) এর যেকোনোটি দিয়ে ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। আর এই ভাইরাস বহন করে এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস প্রজাতির মশা। এডিস ইজিপ্টি স্বভাবগতভাবে গৃহপালিত ও নগর কেন্দ্রিক। এটি আমাদের শহরে ঘরের ভেতরে এবং এর কাছাকাছি থাকে। এজন্য এটিকে আমরা গৃহপালিত মশা বলে থাকি।

এডিস ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গু বিস্তারে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে। আরেকটি প্রজাতি এডিস এলবোপিকটাস যাকে এশিয়ান টাইগার মশা বলা হয়। এটি বন্য বা জংলি বা গ্রামের মশা। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই এ মশাটি রয়েছে।

এই প্রজাতি ডেঙ্গু বিস্তারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এই মশা বিভিন্ন পাত্র ছাড়াও গাছগাছালি যুক্ত এলাকায় গাছের কোটর, কলা গাছের দুই পাতার মাঝখানে, কচু পাতার মাঝখানে, কাটা বাঁশের গোড়ায় জমে থাকা পানিতে জন্মায়।

নগরে এডিস ইজিপ্টি মশা জন্মানোর জন্য অন্যতম স্থান হলো ড্রাম, টায়ার, বালতি, যেকোনো ধরনের মাটির পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের গর্ত, টাইলস ভেজানোর চৌবাচ্চা, কিউরিং-এর পানি জমার স্থান বিশেষ করে বেজমেন্ট।

আমাদের জানা উচিত, কীভাবে আমরা আমাদের পরিবারকে ডেঙ্গু মুক্ত রাখতে পারব। ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা, যেটিকে সরকার বা সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি।

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার জন্য কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি। নির্দেশনাগুলো হলো— এডিস মশার জন্ম হয় পাত্রে জমে থাকা পানিতে। সপ্তাহে অন্তত একদিন আপনার বাড়ি এবং বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখুন, কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমে আছে কি না তা ভালো করে লক্ষ্য করুন। যদি থাকে তাহলে তা ফেলে দিন বা পরিষ্কার করুন। যদি পাত্রটি এমন হয় যে পানি ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না তাহলে সেখানে কীটনাশক বা কেরোসিন বা ব্লিচিং পাউডার বা লবণ দিন।

গাড়ির অব্যবহৃত টায়ার বাসায় রাখবেন না কারণ এখানে এডিস মশার জন্ম হয়। যদি রাখতেই হয় তাহলে ছাউনির নিচে রাখুন যেন পানি জমা না হয়। দই বা যেকোনো খাবারের পাত্র বাইরে ফেলবেন না।

বাথরুমে যদি পানি ধরে রাখতে হয় তাহলে পানির পাত্র সপ্তাহে অন্তত একবার ব্লিচিং পাউডার বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালো করে ধুয়ে আবার পানি ভর্তি করুন। এডিস মশা পানির পাত্রের কিনারে ডিম পাড়ে এবং পাত্রের গায়ে আটকে থাকে। যে কারণে পানি ফেলে দিলেও ডিম নষ্ট হয় না। তাই এটিকে ব্লিচিং পাউডার বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালোভাবে ঘষে পরিষ্কার করা প্রয়োজন।

নগরে এডিস ইজিপ্টি মশা জন্মানোর জন্য অন্যতম স্থান হলো ড্রাম, টায়ার, বালতি, যেকোনো ধরনের মাটির পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের গর্ত, টাইলস ভেজানোর চৌবাচ্চা, কিউরিং-এর পানি জমার স্থান বিশেষ করে বেজমেন্ট।

আপনার বাড়ির পাশে কোনো নির্মাণাধীন ভবন থাকলে, এটির বেজমেন্ট, লিফটের গর্ত, ইট ভেজানোর চৌবাচ্চা, ড্রাম পরীক্ষা করুন। যদি এসব জায়গায় জমে থাকা পানিতে ছোট ছোট পোকা দেখতে পান তাহলে বুঝবেন সেটি এডিস মশার লার্ভা বা বাচ্চা। নির্মাণাধীন ভবনের মালিককে সামাজিকভাবে চাপ প্রয়োগ করুন যেন সে তার বাড়িতে মশা জন্মানোর স্থান তৈরি না করেন। নির্মাণাধীন ভবনটি যদি আপনার হয় তাহলে সেখানে জমে থাকা পানিতে কীটনাশক বা কেরোসিন বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে রাখুন।

আপনার বাড়ির আশেপাশে যদি মশা জন্মানোর মতো কোনো সরকারি, বেসরকারি স্থাপনা থাকে তাহলে ওই অফিসকে জানান।

বাড়ির আশেপাশে গাছের গর্ত বা কাটা বাঁশের গোড়া মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিন। কারণ গাছের কোটর বা বাঁশের গর্তে এডিস মশার জন্ম হয়।

মনে রাখবেন আপনার আমার বাড়ির আশেপাশে পানি জমে থাকা পাত্রে এডিস মশার জন্ম হয়। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন, ডেঙ্গু মুক্ত থাকুন।

আপনার-আমার সম্পৃক্ততা এবং সামান্য কার্যক্রমই পারে আপনার আমার পরিবারকে ডেঙ্গু মুক্ত রাখতে। আমাদের সবার পরিবার ডেঙ্গু মুক্ত থাকলেই দেশ ডেঙ্গু মুক্ত হবে।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ; গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়