প্রয়াত হলেন শেখ আবদুল হাকিম; কে এই শেখ আবদুল হাকিম? পত্রিকার পাতা জুড়ে তার মৃত্যু নিয়ে প্রচারিত শোকগাথা পড়ে বিদ্যায়তনিক পণ্ডিতদের অনেকেই হয়তো হতচকিত হবেন। মনে হবে অচেনা কেউ একজন। কিন্তু পণ্ডিতি দুনিয়ার বাইরে বিপুলসংখ্যক পাঠক জানেন তিনি কে। ভৌতিক তার উপস্থিতি। ভৌতিক না হয়ে যায়ই না, কারণটা সোজা, তিনি তো ‘ঘোস্ট রাইটার’, ভূতুড়ে লেখক! সার্বক্ষণিক তার উপস্থিতি, কিন্তু থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দীক্ষিত পাঠক জানেন আবদুল হাকিম ভৌতিক লেখক নন, মৌলিকও লেখকই বটে।

গ্রন্থস্বত্ব ও রয়্যালিটি নিয়ে হঠাৎ একবার তুমুল আলোচনায় এলেন তিনি। তারপর কাগজে কলমে জানা গেল শেখ আবদুল হাকিম বাংলাদেশের বিখ্যাত গোয়েন্দা কাহিনি মাসুদ রানা সিরিজের লেখক। অবশ্য গোয়েন্দা কাহিনির ভক্ত পাঠকরা জানতেন সিরিজটির পেছনে আছেন প্রধানত দুজন লেখক—কাজী আনোয়ার হোসেন ও শেখ আবদুল হাকিম।

প্রথমজনের মস্তিষ্ক প্রসূত সন্তান মাসুদ রানা, কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে দ্বিতীয়জন লিখেছেন প্রায় আড়াইশ বই। কুয়াশা সিরিজ নামের আরেকটি কাহিনির জন্য বই লিখেছেন পঞ্চাশটি। বিরাট এক আয়োজন, বিপুল এক সম্ভার।

কাজী আনোয়ার হোসেন যখন জনপ্রিয়তার প্রবল প্রতাপে লিখে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না, তখনই যুক্ত হয়েছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। কাজটি ছিল টাকার বিনিময়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে লেখা। ব্যাপারটি আমাদের দেশে খুব বেশি স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত না হলেও পৃথিবীর বহু ভাষার সাহিত্য ও লেখালেখিতে মান্য রীতি।

গোয়েন্দা কাহিনির মতোই সন্দেহ প্রবণ মনে প্রশ্ন তৈরি হয়, মাসুদ রানার কাহিনিগুলো প্রকৃতপক্ষে কত জন লেখক লিখেছেন? কারা কারা লিখেছেন? সিরিজের কোন বইটি কার? সব প্রশ্নের মীমাংসা ঘটেনি। ঝুলে আছে মামলা।

রায় যা-ই হোক-না-কেন দুজনের হিস্যার ব্যাপারে পাঠকসমাজ প্রশ্নাতীতভাবে নিশ্চিত। আর নিশ্চিতভাবে জানেন যে, মাসুদ রানার দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ কাহিনিগুলো না পড়ে ওঠা যায় না। পাতায় পাতায় সাসপেন্স, দুঃসাহসিক অভিযান, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, এক শহর-ভূখণ্ড পেরিয়ে অন্য শহর, স্থানিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর পেরিয়ে অন্য পরিসরে ঢুকে যাওয়া—এসবের তুমুল টান উপেক্ষা করা মুশকিল।

শেখ আবদুল হাকিম এ রীতিতেই বর্ণনা করেছেন গোয়েন্দা আখ্যান। দক্ষ কথকতা ছাড়া কিংবা পর্যবেক্ষণের তীক্ষ্ণতা ছাড়া গোয়েন্দা কাহিনি লেখা অসম্ভব।

ধরা যাক, মিশন তেল আবিব বইটির কথা। গোয়েন্দা প্রধান রাহাত খান টানা বলে যেতে লাগলেন মাসুদ রানার অপকর্মের বিবরণ; যেগুলোর একটিও রানা করেনি। তাহলে কে করল? কেন করল? সবগুলো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রে।

একদিন আমরাও পাঠ্যবইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে পড়তাম মাসুদ রানা কিংবা কুয়াশা সিরিজের বই। কেন পড়তাম? হয়তোবা অন্য এক আমির পেছন পেছন ছুটে যেতাম...

ফিলিস্তিনি নৃত্য শিল্পী শাকিলা মেহরুন কাজ করছে বাংলাদেশের হয়ে। উপন্যাসটির প্রথম পরিচ্ছেদে দেওয়া হলো টুকরো টুকরো তথ্য ও কৌতূহল উদ্দীপক প্রসঙ্গ। আর তাই টানতে থাকে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। সেদিনই বৈরুতের উদ্দেশ্যে তাকে চলে যেতে হয় নতুন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে।

চমকপ্রদ এই আরম্ভ টেনে নেয় পাঠকের মনকে; মনের চোখ দিয়ে যে বুঝতে চায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন-বাংলাদেশ সম্পর্ক। বিশ্ব রাজনীতির কারণে মোসাদের রহস্যময় কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশেষ আগ্রহ তো জমাই আছে পাঠকের মনে। অতএব এ বই না পড়ে ওঠার উপায় নেই। এভাবেই টেনে ধরেন মাসুদ রানা কিংবা শেখ আবদুল হাকিম।

সত্যি বলতে কি, গল্প, চরিত্রায়ন, পটভূমি—এই তিন বিন্দু মিশে গেছে মাসুদ রানা সিরিজের উপন্যাসগুলোতে। বাংলাদেশি তরুণের ‘অন্য এক আমি’ অতিক্রম করতে চায় দেশকালের সীমানা। কোথায় নেই মাসুদ রানা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন, রাশিয়া... অনেক অনেক স্থান ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের উৎস হয়ে ওঠে মাসুদ রানা সিরিজ।

কৈশোর ও তারুণ্যের কাছে ফিরে গেলে দেখতে পাই, একদিন আমরাও পাঠ্যবইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে পড়তাম মাসুদ রানা কিংবা কুয়াশা সিরিজের বই। কেন পড়তাম? হয়তোবা অন্য এক আমির পেছন পেছন ছুটে যেতাম। যে আমি সুদূরের পিয়াসী?

মগ্নচৈতন্যে যে চায় রহস্যের অন্ধকারগুলো মেলে ধরতে। যে জানে ওইসব অচেনা শহর ও জনপদে চাইলেও সে ছুটতে পারবে না; কিন্তু মাসুদ রানা তো পারে, তার পেরে ওঠাই আমার পেরে ওঠা। এ কারণে মাসুদ রানা হয়ে উঠতে পেরেছিল তারুণ্যের আইকনিক ক্যারেক্টার।

গণমাধ্যমের যখন বিস্ফোরণ ঘটেনি, সেই সত্তর-আশি-নব্বই দশকে ‘মফস্বল’ গন্ধমাখা বাংলাদেশে বসে মেট্রোপলিটন সিটির স্বাদ এনে দিত মাসুদ রানা। মানসিক ভ্রমণ আমাদের নিয়ে যেত সমুদ্র, মরুতে।

মাসুদ রানার একেকটা মিশন ছিল দীর্ঘ এক সফর। আর তাই মাসুদ রানাকে যে, যিনি কিংবা যারা তৈরি করতে পারেন তাদের জন্য তারুণ্যের ভালোবাসা প্রখর। শেখ আবদুল হাকিম সে ভালোবাসা পেয়েছেন। থ্রিলার, গোয়েন্দা কাহিনি—এ ধরনের সাহিত্যিক ধারার কাজ স্বাভাবিক এই মানবিক প্রবৃত্তি নিয়ে।

গণমাধ্যমের যখন বিস্ফোরণ ঘটেনি, সেই সত্তর-আশি-নব্বই দশকে ‘মফস্বল’ গন্ধমাখা বাংলাদেশে বসে মেট্রোপলিটন সিটির স্বাদ এনে দিত মাসুদ রানা। মানসিক ভ্রমণ আমাদের নিয়ে যেত সমুদ্র, মরুতে...

ফুটপাতে বই কিনতে গিয়ে বহুবার দেখেছি, দশ-বারোটা বই নিয়ে দাঁড়িয়েছে অল্প বয়সী তরুণ; ওই বইগুলো ফেরত দিয়ে, কিছু টাকা যোগ করে নতুন আরও ডজন খানেক বই নিয়ে যাবে পড়তে।

মনে মনে ভেবেছি, এই পাঠ তৃষ্ণা নিশ্চয়ই এক ধরনের ক্যাথারসিস ঘটাচ্ছে। হ্যাঁ, সত্যিই! কোনো রহস্য ও প্রশ্নের সমাধান করতে পারা নিঃসন্দেহে বিমোক্ষণের আনন্দ দেয়। চোখের সামনে ধাপে ধপে খুলে যাচ্ছে সংশয়, দ্বিধা ও কল্পনার জট—নিছক আনন্দ বলে একে উড়িয়ে দেওয়া যায় না; কারণ মানবিক প্রবৃত্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে সংশয়-জিজ্ঞাসা।

আমাদের দেশে পাঠকের কাছে গোয়েন্দা কাহিনি যতখানি জনপ্রিয়, অ্যাকাডেমিকের কাছে তা প্রায় ততোটাই অপ্রিয়। বিগত একশ বছরে বাংলা ভাষায় রচিত গোয়েন্দা কাহিনি প্রসঙ্গে বিদ্যায়তনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা নজরে পড়েনি। হয়তো পাতে তোলার যোগ্য মনে হয়নি। অথচ আমাদের সাহিত্যেই আছে ব্যোমকেশ, ফেলুদা, মাসুদ রানা। পণ্ডিতি মন এসবে মজে না—এ কথা বলা মুশকিল।

ইউরোপ-আমেরিকান বিদ্যায়তনে গোয়েন্দা কাহিনির ভাষ্য উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। ক্ষমতা-রাজনীতির সম্পর্ক বুঝতে গোয়েন্দা কাহিনি সহায়তা করে থাকে। আমরাও দেখতে পারি, গোয়েন্দা কাহিনিতে কীভাবে প্রতিফলিত হলো বাংলাদেশের আত্মপরিচয়, নিরাপত্তা প্রতিরক্ষা ও বিশ্ব রাজনীতির সম্পর্ক।

আরেকটি কথা কথা বলে লেখার ইতি টানব। সেটি শেখ আবদুল হাকিমের অন্য এক পিঠ—ক্লাসিকস অনুবাদক আবদুল হাকিম। গোয়েন্দা কাহিনিকে ধরা হয়, সাময়িক ইস্যু; কোনো একটি সমস্যার সমাধান হওয়া মাত্র ফুরিয়ে যায় তার আবেদন। তাই কি তিনি বেছে নিয়েছিলেন চিরায়ত ধারার সাহিত্য?

যিনি মাসুদ রানা লিখেছেন তিনিই অনুবাদ করছেন থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, ফ্রাঙ্কেস্টাইন, হাকেলবেরি ফিন’র দুঃসাহসিক অভিযান। এক দিকে গোয়েন্দা কাহিনি, রহস্য-উপন্যাস, অন্য দিকে ধ্রুপদী সাহিত্য—এই মেলবন্ধন আশি-নব্বইয়ে কিশোর তরুণকে উদ্দীপিত করেছিল। আজকের অনেক তরুণ বিশ্বসাহিত্যের পাঠ নিতে শিখেছে এসব বইয়ের হাত ধরে; আবদুল হাকিম সেখানেও প্রাসঙ্গিক থেকে যাবেন।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়