এয়ারলাইন্সের পাইলট, কেবিন ক্রুরা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পদ! কারণ এরা শুধু দেশের গণ্ডির মধ্যে নিজের দেশকেই সেবা দেন না, দিগন্তকে উন্মুক্ত করেন মানুষের কল্যাণে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাই কেউ চাইলেই হুট করে পাইলট হতে পারেন না। বাবার অঢেল সম্পত্তি থাকলেই বংশ পরম্পরায় সে সম্পত্তি হস্তান্তর করে কেউ বৈমানিক হতে পারেন না।

অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে একজন ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে বৈমানিক হয়ে উঠতে হয়। তাই এই পেশা শুধু পদ-পদবীর অহংকার নয়। এই পেশা পর্যায়ক্রমিকভাবে সফলতা অর্জনের বিষয়। অন্যের বোঝা নিজ কাঁধে বয়ে বেড়ানোর ব্যথা রয়েছে এখানে।  

সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য মানুষের যে সব চাহিদা রয়েছে, ককপিট বা কেবিন ক্রু হতে গেলে সেই স্বাভাবিক জীবন থেকে উল্টো পথে গিয়ে তাদের এ ধরনের পেশায় থিতু হতে হয়। তাই বলা হয়ে থাকে পেঁচার মতো জীবন এ পেশার মানুষদের। এ কারণে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হতে হয় ক্রুদের।

পৃথিবী যখন বেঘোরে ঘুমায় তখন এরা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো ঠায় জেগে থাকে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের আনা নেওয়া করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।

হাজারো নিরাপত্তা ও জরুরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ সফলভাবে সম্পন্ন করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে আকাশ পথে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই এ পেশার দায়।

বৈমানিক নওশাদের মতো একজন দক্ষ বৈমানিক যখন কর্তব্যরত অবস্থাতেই হুট করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তখন এরকম একটি আকস্মিক ঘটনা আমাদের মেনে নিতে যারপরনাই কষ্ট হয়।

চাকরি জীবনে বিমানে প্রথমে যোগদান করেছিলাম কেবিন ক্রু হিসেবে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। চাকরি আর লেখাপড়া এক সাথে করার কারণে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বেশিরভাগ সময়ে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট অপারেট করতে হতো। সে কারণে আমার মতো যে পাইলটরা প্রতিদিন অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করতেন, তাদের সাথে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো। এখনো বহুবছর পর বিমানে ভ্রমণ করলে তাদের সাথে দেখা হলে পরিবারের সদস্য মনে হয়। মনে হয় অনেক দিন পর হয়তো আপন ভাইবোনের সাথেই দেখা হলো।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর ক্যাপ্টেন নওশাদ মাঝ আকাশে অসুস্থ হয়ে একাকী একটি অচেনা অজানা দেশের হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে কীভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, এ কথা ভাবতে সত্যি গতকাল থেকে ভীষণ বিচলিত বোধ করছি। ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে জানাশোনা না থাকলেও সহকর্মীদের যেকোনো খবরে মনে হয় আমরা সকলেই এক পরিবারের ভাইবোন। যদিও এটি আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি।

তাই নাম শুনে তাৎক্ষণিকভাবে বৈমানিক নওশাদকে মনে করতে না পারলেও ছবি দেখে মনে পড়ল এই তিনিই তো সেই বৈমানিক যিনি ২০১৭ সালে মাস্কাট ফ্লাইট থেকেই আসার পথে বিমানের খুলে যাওয়া চাকার অংশ নিয়ে ১২২ জন যাত্রীসহ সফলভাবে জরুরি অবতরণ করেছিলেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! সেই মাস্কাট রুট এ আবারও তিনি গত ২৭ আগস্টও ফিরতি ফ্লাইটে ১২৪ জন যাত্রী নিয়ে পথে মধ্য আকাশে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে কো-পাইলটের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।

পরবর্তীতে কো-পাইলট ওই ফ্লাইটটিকে ভারতের মহারাষ্ট্রের নাগপুরের ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করেন। সেখান থেকে বৈমানিক নওশাদকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নওশাদ একবার নয়, দুইবার নয়, বেশ কয়েকবার বড় ধরনের বিমান দুর্ঘটনা থেকে যাত্রীদের রক্ষা করে সফল ল্যান্ডিং করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে এরকম মূল্যবান প্রাণের রক্ষায় যেন কোনো অবহেলা না হয় সে প্রচেষ্টা করা উচিৎ নিজেদের স্বার্থেই।

ক্যাপ্টেন নওশাদের এভাবে চলে যাওয়ায় মনের মাঝে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। গতকাল বেসরকারি টেলিভিশনের একটি টক শো দেখলাম। দেখার পর মনের মাঝে প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলেনি। আমি বিমানের প্রাক্তন কর্মী হয়েও মনে হচ্ছে, একজন বৈমানিক যেমন সম্পূর্ণ ফ্লাইটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন, তেমনি তাদের জীবনের নিরাপত্তার দায় কার? সেরকম দায়িত্ব কি পালন করা হয়েছে? নাকি শুধু সেট করা কথাই বলা হচ্ছে? এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে তাৎক্ষণিক তথ্য জানাতো খুব কঠিন বিষয় নয়। তাছাড়া বিমান কর্তৃপক্ষের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়ে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা প্রচলিত নিয়মের মধ্যে পড়ে কি না তা আমার জানা নেই। তবে এরকম ব্যবস্থায় পরবর্তীতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কারণ এরা আমাদের সকলের সম্পদ। একদিনে একজন ক্যাপ্টেন নওশাদ কেউ তৈরি করতে পারবে না।

সাবিনা শারমিন ।। সাবেক ব্যবস্থাপক, প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স