বর্তমান বাংলাদেশে এমন একটি দল ক্ষমতায় যেই দল তার দেশের সকল বিরোধীদলকে ঘোল খাইয়ে একা একচেটিয়া নির্বাচন করে দোর্দণ্ডপ্রতাপে ক্ষমতায় বারবার ফিরে আসতে পারে। এমন একটি দল ক্ষমতায় যেই দল দেশে কেউ সরকারের বিরুদ্ধে ফেসবুক সামান্য একটা স্ট্যাটাস দিয়েও পার পেতে দেয় না। সেই দেশে কেমন করে একের পর এক পূজামণ্ডপ হামলা করে সব কিছু গুড়িয়ে দেয়? কেমন করে একের পর হামলা করে মানুষ মারে বা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় কেবল হিন্দু হওয়ার কারণে?

হিন্দুদের উপর হামলার সময় এত ক্ষমতাবান সেই সরকার কেন এত দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়? যেই দলের সাথে ভারত এবং দেশের হিন্দুদের বিশেষ সখ্যতা আছে বলে ধরে নেওয়া হয় সেই রকম সরকার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এমন আক্রমণ যদি হয় তাহলে হিন্দুরা নিজেদের দেশে কতটা অসহায় ভাববে, একটু ভেবে দেখুন। 

যদি বর্তমান সরকারি দলের সকল অঙ্গসংগঠনকে অসাম্প্রাদিকতা শেখানো হতো, দলের আদর্শ শেখানো হতো তাহলেও বাংলাদেশকে আজকের অবস্থায় দেখতে হতো না। এত নৃশংস হামলা হলো অথচ সরকারি দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের কাউকে প্রতিহত করতে দেখা গেল না। সরকারের হাতে প্রশাসন, পুলিশ, গোয়েন্দা, দলীয় কর্মী সব। এতসব থাকতে এই ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটে?

এই দেশের সকল মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কেউ ষড়যন্ত্র করে থাকলে তাদের ধরার দায়িত্বও সরকারের।

প্রধানমন্ত্রী বা দলের কাউকে কোনো অবমাননা করে ফেসবুকে কিছু লিখলে তাদের খুঁজে বের করে জেলে পুড়তে তো কোনো সময় লাগে না। অথচ অতীত অভিজ্ঞতাও যদি কাজে লাগাই আমরা কি জানি না শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কিছু ঘটতে পারে। তা সত্ত্বেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?

এই দেশের সকল মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কেউ ষড়যন্ত্র করে থাকলে তাদের ধরার দায়িত্বও সরকারের। ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের। আমরা এই ঘটনার বিচার না চেয়ে, প্রতিবাদ না করে যদি কেবল ষড়যন্ত্র দেখি তা খুবই দুঃখজনক। সমস্যাগুলোকে ঝাড়ু দিয়ে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখলেই সমস্যা উধাও হয়ে যায় না!

আমরা মানে মুসলমানরা সবাই বলি ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম। তো এই কথাটা কারা বলবে? আমরা যদি নিজেদের ধর্মকে শান্তির ধর্ম বলি তাহলেই কি শান্তির ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে? ভুলে যাই যে, পৃথিবী অনেক বড়। বাংলাদেশে বাস করে মনে হতে পারে নিজের দেশটাই বুঝি পৃথিবী কিন্তু এটাই পৃথিবী না। ইসলাম ছাড়াও এই বড় পৃথিবীতে আরও ৪২৯৯টি ধর্ম আছে।

এই পৃথিবীর সবদেশ মিলে যদি একটা রাষ্ট্র হতো তাহলে খ্রিস্টানরা হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিশ্বজনসংখ্যা রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৭৭১.৫০ কোটি। এর মধ্যে খ্রিস্টান প্রায় ২৪০ কোটি। ইসলাম প্রায় ২০০ কোটি। নন রিলিজিয়াস যেমন এথিস্ট, সেক্যুলার প্রভৃতি যাদের সংখ্যা ১৫০ কোটি। হিন্দু প্রায় ১৩০ কোটি। বৌদ্ধ প্রায় ৬০ কোটি। হ্যান ধর্ম চীনের সবচেয়ে বড় ধর্ম। এদের সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। শিখ প্রায় ৩ কোটি। ইহুদি প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ।

যে যেই ধর্মেরই হোক না কেন রাষ্ট্র সবার। একটি রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের অধিকার সমান। এই অধিকার ধর্ম দ্বারা নির্ধারিত হলে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী কখনোই হবে না।

আবার প্রত্যেকটা ধর্মই অন্য সকল ধর্মের সাপেক্ষে সংখ্যালঘু। যেমন পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মধ্যে অধিকাংশ মানুষই মুসলিম না। এখন এই দেশে থেকে মুসলমানরা অন্য ধর্মের মানুষকে একভাবে দেখে, সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান দেশে থেকে খ্রিস্টানরা অন্য ধর্মের মানুষকে আরেকভাবে দেখে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দেশে থেকে হিন্দুরা অন্য ধর্মের মানুষকে অন্যভাবে দেখে। কিন্তু আমরা সবাই যদি আমাদের দৃষ্টিকে বড় করি তাহলেই বুঝতে পারব পৃথিবীতে সকলের শান্তি চাইলে সবাইকে একইভাবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে হবে।

যে যেই ধর্মেরই হোক না কেন রাষ্ট্র সবার। একটি রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের অধিকার সমান। এই অধিকার ধর্ম দ্বারা নির্ধারিত হলে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী কখনোই হবে না। তাই আমরা যদি বড় ক্যানভাসে ভাবতে শিখি তাহলেই কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। 

সকল ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং ধর্মের কারণে কাউকে সম্মান করা বা অসম্মান না করা শেখাতে হবে ছোটবেলা থেকেই। অথচ আমরা কী করি? স্কুলেই ধর্ম শিক্ষার নামে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেই সবার ধর্ম এক না। তারা আলাদা ক্লাস করে ধর্মের ভিত্তিতে ছোটবেলার ক্লাসকে আলাদা করে ফেলাটাই ভুল শিক্ষা।

ধর্ম যদি স্কুলে থাকতেই হয় সেই ক্লাস হতে পারত সকল ধর্মের সমন্বয়ে প্রণীত একটি ধর্ম ক্লাস যেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধর্মের নৈতিকতা, মহানুভবতা ইত্যাদি বিষয় থাকবে।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ধর্মের ভিত্তিতে এখনো আবাসিক হল ব্যবস্থা রেখেছি যেমন সলিমুল্লাহ বা ফজলুল হক, মুসলিম হল। জগন্নাথ, হিন্দু হল। এইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশ্বের কোথায় আলাদা আবাসিক হল আছে? এমনকি আমাদের দেশেই কোন ধর্ম শান্তির আর কোন ধর্ম অশান্তির সেইটা বিচারের ভার অন্য ধর্মের মানুষদের ওপর।

অন্য ধর্মের মানুষেরা যখন কোনো একটি ধর্মকে শান্তির ধর্ম ভাবে তবে সেটিই হবে সত্যিকারের শান্তির ধর্ম। নিজ নিজ ধর্মকে সবাই শান্তির ধর্মই ভাবে। কারণ সকল ধর্মই পুঁথিগতভাবে শান্তির কথা বলে, ভালো কথা বলে। আমাদের বুঝতে হবে নিজে যাকে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।

ইউরোপ-আমেরিকায় অধিকাংশ মানুষের ধারণা বৌদ্ধ ধর্ম হলো নিরীহ এবং শান্তিপ্রিয় ধর্ম। বৌদ্ধ কেমন শান্তির ধর্ম সেটা জানতে রোহিঙ্গাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। ইহুদি কেমন শান্তির ধর্ম সেটা জানতে ফিলিস্তিনিদের জিজ্ঞেস করতে হবে। মুসলমান কেমন শান্তির ধর্ম সেটা জানতে বাংলাদেশের হিন্দুদের জিজ্ঞেস করতে হবে। হিন্দু কতটা শান্তির ধর্ম সেটা জানতে ভারতের মুসলমানদের জিজ্ঞেস করতে হবে। কেবল শান্তির ধর্ম বলে মুখে ফেনা তুলে লাভ নেই। ধর্মের নাম করে মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে দিয়ে ধর্মের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তারা নিজেরাই করে।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়