ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো ঘটার পর নানা মাত্রিক আলোচনা হয়— কী সরকার, কী জনগণ বা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন— আমরা প্রত্যেকেই এই সন্ত্রাস দমনে নানা আলোচনা করি। সমাজে দিনকে দিন সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব বৃদ্ধির যে চিত্র আমরা দেখছি, তাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কোনো একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন, ‘সংখ্যালঘু’ অধিকার সংরক্ষণে কমিশন প্রয়োজন ইত্যাদি নানা আলোচনা স্বয়ং সরকারের তরফ থেকেও করা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্প্রীতি সমাবেশ ও মিছিলও আমরা দেখেছি। রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা এটি করতেই পারেন এবং করাই উচিত; কিন্তু প্রশ্ন যেটি দাঁড়াচ্ছে তা হলো— এর বাইরে কি তাদের আর কিছু করার নেই?

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে জনমনস্তত্ত্বে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন— আমি তা কোনোভাবেই অস্বীকার করছি না; কিন্তু একই সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই— বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থারও সংস্কার প্রয়োজন। কেবল জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিত থেকে কথাটি বলছি না, দলীয় রাজনীতির পরিধিতেও সার্বিক সংস্কার প্রয়োজন— সেটা অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ধারণ করা প্রতিটি দলেই। এখন এর শুরুটা কোত্থেকে হওয়া উচিত— এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও— আমার বিবেচনায় কাজগুলোকে তাদের স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী চলতে দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দায়িত্ব রয়েছে, সে দায়িত্বগুলো ঠিকমতো পালন করলেই দৃশ্যপট বদলাতে দুই বছরের বেশি সময় লাগার কথা নয়।

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে সারাদেশে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চলেছিল, তার শিকার হয়েছিলেন খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই।

বাংলাদেশে বারবার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ঘটনার পরই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা প্রতিবাদ করেছেন, আইন অনুযায়ী মামলা হচ্ছে, আসামিও ধরা পড়ছে অনেক জায়গায় কিন্তু তারপর সবকিছুই কেমন শুভঙ্করের ফাঁকির হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।

২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হয়েছে? চলমান শতাব্দীর প্রথম দশকে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে সারাদেশে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চলেছিল, তার শিকার হয়েছিলেন খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। গত এক যুগেরও অধিক সময় ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়— তৎকালীন সন্ত্রাসগুলোর বিচার হয়েছে কি?

এ প্রশ্নগুলোকে সামনে রেখে গত প্রায় নয় বছর ধরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসগুলোর বিচার কার্যক্রম দেখলে আমরা ব্যথিত হলেও সম্ভবত অবাক হই না।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির পর সারাদেশের ২২টিরও বেশি জেলায় চালানো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়া, ২০২০ সালে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, কুমিল্লার মুরাদনগর বা ভোলার মনপুরায় ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস বা ২০২১ সালে মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও নির্যাতন, ২০২১ সালের অক্টোবরে শারদীয় দুর্গোৎসব চলাকালীন পূজামণ্ডপ ও হিন্দু বাড়িঘরে হামলা— কোন ঘটনায় আমাদের বিচার বিভাগ মামলার কাজ শেষ করতে পেরেছে?

বিচারের প্রশ্নে আইন ও বিচার বিভাগের এই যে সম্মিলিত ব্যর্থতা, এগুলোর সুযোগেই বেড়ে চলছে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা। শুধু তাই নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা একটি উল্টো বিচারের প্রবণতা লক্ষ্য করছি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকেই কোনো একজনকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ডিজিটাল আইনের খড়গ চালানো হয়।

বিনা দোষে জেল খাটেন রসরাজ বা ঝুমন দাস, ফেরারি হন উত্তম বড়ুয়া, জীবন শেষ হয় টিটো রায়ের। এখন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার মানুষেরা সর্বস্ব হারিয়েও এই দুশ্চিন্তায় থাকেন যে, কখন তাদের মধ্য থেকেই একজনকে ধরে নিয়ে প্রশাসন কথিত ‘কোরান অবমাননার’ হাতকড়া পড়াবে।

গত নয় বছর ধরে সংঘটিত প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে ফেসবুকের মাধ্যমে সন্ত্রাসকে সারাদেশে ছড়ানো হয়েছে। কারও আইডি হ্যাক করে, কারও নামে ভুয়া আইডি বানিয়ে...

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসগুলোতে আগে মসজিদের মাইক ব্যবহৃত হতো। এখনো হয়, তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। গত নয় বছর ধরে সংঘটিত প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে ফেসবুকের মাধ্যমে সন্ত্রাসকে সারাদেশে ছড়ানো হয়েছে। কারও আইডি হ্যাক করে, কারও নামে ভুয়া আইডি বানিয়ে বা কখনো একটি বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিষয়টি প্রতিরোধে সরকারের উদ্যোগগুলো কী কী? আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকার কি এ বিষয়গুলো উত্থাপন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেছে? যদি সাম্প্রতিক সন্ত্রাস পরিস্থিতিগুলোই বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে— মূলধারার গণমাধ্যমে সন্ত্রাসের সংবাদ প্রচারিত না হলেও ফেসবুক বা ইউটিউবের মাধ্যমে সহিংসতার মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। ফল হয়েছে উল্টো।

রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে আমি এই তথ্য জানতে চাইতেই পারি— সাম্প্রতিক সন্ত্রাস পরিস্থিতি দমনে সরকার ফেসবুকের কাছে কতগুলো পোস্টের বিষয়ে টেকডাউন রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে? সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ফেসবুক কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?

সরকার যদি বরাবরের মতোই বলে—‘ফেসবুক আমাদের কথা শোনে না’—তাহলে কি সরকারের উচিত নয় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের অনুঘটক হিসেবে ফেসবুকের নেতিবাচক এই কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া।

গত নয় বছরে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সংঘঠিত হওয়া ও ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ফেসবুক বাংলাদেশে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে অন্য যেকোনো দেশ হলে ফেসবুককে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতো। এমন নজিরও আছে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে।

আমি রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাই— সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমনে ফেসবুকের কাছে রাষ্ট্রের প্রদেয় টেকডাউন রিকোয়েস্টের সঠিক সংখ্যা কত, ফেসবুকের প্রতিক্রিয়া এবং এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ। কারণ আমাদের রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলেন যেন, কোনোভাবেই তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। ফেসবুক তো কোনো রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো নয়, বিশ্বব্যাপী ব্যবসা চালানোর একটি বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মাত্র।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের সচেতন মানুষেরা বারবার কথা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই কথা বলছেন; কিন্তু ফলাফল কার্যত শূন্য। এই উদ্যোগহীন প্রচেষ্টার শূন্য ফলাফলের দায় ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে বর্তাবে। প্রতিক্রিয়া আরও বড় ও ভয়াবহ হবে। তখন সরকার উদ্যোগ নিতে গেলে দেখবেন— সময়ের ট্রেন বহু আগেই প্লাটফর্ম ছেড়ে গেছে।

মারুফ রসূল ।। ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্লগার