ছবি : সংগৃহীত

১৮৯৪ সালের পয়লা জানুয়ারি। এই দিনে কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্সের জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসু কলকাতার ২২ ঈশ্বর মিত্র লেন, গোয়াবাগানে জন্মগ্রহণ করেন। বোস ছিলেন ছয় বোনের একমাত্র ভাই এবং সবার বড়। বোসের বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন কলকাতা রেলের একজন হিসাবরক্ষক এবং পরবর্তীতে তিনি একটি কেমিক্যাল কারখানা দেন।

১৮৯৯ সালে বোস উত্তর কলকাতার ‘নর্মাল স্কুল [Normal school]’ ভর্তির মাধ্যমে লেখাপড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি হন। আবার স্কুল পরিবর্তন করে ১৯০৭ সালে কলকাতার সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে ভালো স্কুল ‘হিন্দু স্কুল [Hindu School]’ ভর্তি হন।

১৯০৮ সালে বোস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসএসসি পরীক্ষা দেন যার ফল প্রকাশ হয় ১৯০৯ সালে। এসএসসি (তখনকার এন্ট্রান্স পরীক্ষা)-তে তিনি মেধা তালিকায় পঞ্চম হয়ে সেই বছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন, যেখানে তিনি সহপাঠী হিসেবে পান জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ আর শিক্ষক হিসেবে পান জগদীশ চন্দ্র বসু, সারদা প্রসন্ন দাশ এবং আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে, যারা ছিলেন তৎকালীন বাঙালি জাতির রেনেসাঁর দিকপাল। তারা ছিলেন সত্যেন বসুকে বোস হয়ে উঠার কারিগর।

১৯১১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বোস মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে পাস করেন। সেই বছরই প্রেসিডেন্সি কলেজেই বিএস’এ পড়া শুরু করেন। সেখানে তিনি সহপাঠী হিসেবে পান আমাদের ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা মেঘনাদ সাহাকে। তিনি বিএস পরীক্ষায়ও মেধা তালিকায় প্রথম হন।

এইচএসসি রেজাল্টের জন্য তিনি হরিশ্চন্দ্র পুরস্কার এবং গণিতে সেরা হওয়ার জন্য মন্মথনাথ ভট্টাচার্য স্বর্ণপদক পান। সেই পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন মেঘনাদ সাহা যিনিও পরবর্তীতে ভারতের সর্বকালের সেরা গবেষকদের একজন এবং এই জন্য কলকাতায় এই দুই বন্ধুর নামে দুটি সেরা প্রতিষ্ঠান আছে যার একটির নাম ‘এসএনবোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সাইন্স’ [S.N. Bose National Centre for Basic Sciences] আর অন্যটি হলো ‘সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ [Saha Institute of Nuclear Physics]! ১৯১৫ সালে বোস মাস্টার্সেও রেকর্ড মার্ক পেয়ে প্রথম হন এবং মেঘনাদ সাহা আবার দ্বিতীয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের চেয়ারম্যানের কক্ষে বসে সত্যেন বোস লিখে ফেললেন চার পাতার একটি ছোট্ট গবেষণাপত্র, যার শিরোনাম দিলেন Planck's Law and the Hypothesis of Light Quanta।

আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় যখন কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক তখন সেখানে রিসার্চ স্কলার হিসেবে যোগ দেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পরবর্তীতে তিনি সেখানে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়। যে স্বল্প কয়টি বিভাগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু তার মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান অন্যতম। বোস সেই বিভাগে ‘রিডার’ হিসেবে যোগ দেন। যেহেতু ইতিমধ্যে প্রভাষক হিসেবে বোসের ৪ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। একই সময়ে তার স্কুল বন্ধু জ্ঞানচন্দ্র ঘোষও রসায়ন বিভাগে নিয়োগ পান। নিয়োগ পেয়েই বোস মাস্টার্সের ছাত্রদের কোয়ান্টাম থিওরি পড়ানোর সুযোগ পান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা শ্রেণিকক্ষে সেই বিষয় পড়াতে গিয়েই বন্ধু মেঘনাদ সাহার মাধ্যমে ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি এসব গবেষণা পত্রের খোঁজ পান। ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন আইডিয়ার জন্ম বিজ্ঞানী Gustav Kirchhoff -এর হাত ধরে বোসের জন্মের ৪ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮৯০ সালে।

অনেকের অনেক গবেষণার পর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৯০০ সালে প্ল্যাঙ্ক-এর ‘রেডিয়েশন ল [Planck's radiation law]’ এর মাধ্যমে ধারণা করা হয়েছিল ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন তত্ত্ব পূর্ণতা পেয়েছে। কিন্তু বোস যখন শ্রেণিকক্ষে পড়াচ্ছিলেন তখন উনার কাছে সেই খটকা লাগে। যেই খটকা সারতে গিয়ে জগৎবিখ্যাত তত্ত্বের জন্ম হয় এই কার্জন হলে।

আইনস্টাইন কিন্তু ঠিকই বুঝে ফেললেন এই অখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানীর কাজটি কত গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেরি না করে তিনি বোসের আর্টিকেলটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে পাঠালেন তৎকালীন প্রখ্যাত জার্নাল Zeitschrift für Physik এ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের চেয়ারম্যানের কক্ষে বসে সত্যেন বোস লিখে ফেললেন চার পাতার একটি ছোট্ট গবেষণাপত্র, যার শিরোনাম দিলেন Planck's Law and the Hypothesis of Light Quanta।

সেটি লিখে পাঠিয়ে দিলেন তখনকার দিনে পদার্থবিজ্ঞানের খ্যাতনামা এক জার্নাল ‘ফিলোসোফিক্যাল ম্যাগাজিন [Philosophical Magazine]’-এ। কিন্তু বিধি বাম, জার্নালের সম্পাদক ও সম্পাদনা ডেস্কের লোকজন ভাবলেন, বোস হয়তো একেবারে গোড়ায় গলদ করে এই পেপারটা লিখেছেন, তাই তারা আর্টিকেল রিভিউয়ারের জন্য না পাঠিয়ে রিজেক্ট করে দিলেন।

ইতিমধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কর্তৃপক্ষে মধ্যে সংঘাতের কারণে আর্থিক বরাদ্দ কমে যাওয়ায় ১৯২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে বোসকে দেন, তার নিয়োগ আর বাড়ানো হচ্ছে না। এইরকম একটি খারাপ সময়ের মধ্যেই বোস তার যুগান্তকারী আর্টিকেল লিখেছিলেন।

সেই সময় ফিলোসোফিক্যাল ম্যাগাজিন থেকে আর্টিকেল বাদ পড়ায় তিনি খুব মন খারাপ করলেন। এই সময় তিনি ভাবলেন, লেখাটা আইনস্টাইনকে একবার পাঠানো দরকার। আইনস্টাইন ইতিমধ্যেই বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত পদার্থবিদ হয়ে গিয়েছেন। বোস ভাবলেন, বিশ্বের সেরা প্রতিভা আইনস্টাইন নিশ্চয়ই তার কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন বা বুঝতে পারবেন।

১৯২৪ সালের ৪ জুন। বোস যেই চিঠি লিখলেন সেই চিঠির প্রতিটি শব্দই প্রমাণ করে বোস শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেন না, একই সাথে তিনি মনের ভাব লিখে প্রকাশ করতেও যথেষ্ট পারদর্শী। এই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটিও সবার পড়া উচিত, তাই চিঠির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো—

Respected Sir,
“I have ventured to send you the accompanying article for your perusal and opinion. I am anxious to know what you think of it. You will see that I have tried to deduce the coefficient 8π ν2/c3 in Planck's Law independent of classical electrodynamics, only assuming that the ultimate elementary region in the phase-space has the content h3. I do not know sufficient German to translate the paper. If you think the paper worth publication, I shall be grateful if you arrange for its publication in Zeitschrift für Physik. Though a complete stranger to you, I do not feel any hesitation in making such a request. Because we are all your pupils though profiting only by your teachings through your writings. I do not know whether you still remember that somebody from Calcutta asked your permission to translate your papers on Relativity in English. You acceded to the request. The book has since been published. I was the one who translated your paper on Generalised Relativity.”

গুণীজন বুঝে গুণের কদর, মূর্খের কাছে যা খেলনা। বোসের সাথে ঠিক তাই ঘটেছে। আইনস্টাইনের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত এবং সেইরকম একটি চিঠি সবকিছুই যেন একটি মাহেন্দ্রক্ষণকে নির্দেশ করে।

আইনস্টাইন কিন্তু ঠিকই বুঝে ফেললেন এই অখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানীর কাজটি কত গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেরি না করে তিনি বোসের আর্টিকেলটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে পাঠালেন তৎকালীন প্রখ্যাত জার্নাল Zeitschrift für Physik এ। সাথে যোগ করে দিলেন একটি ছোট নোট যেখানে তিনি এই কাজের প্রশংসা করেন এবং লিখেন তিনি খুব শিগগির এটি তিনি অন্যত্র ব্যবহার করবেন।

আমাদের উচিত ছিল এই দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালন করা। বোসকে কদর করার মাধ্যমে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই ভাবনা ঢুকাতে পারতাম এই মাটিতে বসেও বিশ্বসেরা সব গবেষণা সম্ভব।

বোসের আবিষ্কৃত এবং পরে আইনস্টাইনের হাতে পরিবর্ধিত এই পরিসংখ্যান বিদ্যার নাম দেওয়া হলো বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স এবং তারও পরে আসে বোস-আইনস্টাইন কন্ডেন্সেশন তত্ত্ব।

এই কাজের মাধ্যমে বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বোপরি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগকে বিশ্বে অন্যরকম এক উচ্চতায় নিয়ে যান। এই বিভাগের একজন শিক্ষক হয়ে পৃথিবীর যেখানেই যাই একটা অন্যরকম সম্মান পাই। যদিও আমরা বোসকে যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন কিছু করেনি যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যখন কার্জন হলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে বুঝতে পারবে যে এইখানেই বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের জন্ম।

বোসের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদিও একটি সেন্টার করেছে সেটির দুরবস্থা দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায় আমরা, গুণী মানুষদের যথাযথ সম্মান আমরা করতে জানি না। এই বিশেষ দিনটি উদযাপন উপলক্ষে আজ কোথাও কি কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে? উনার নামে কোনো আবাসিক হল কিংবা ভবন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে?

আমাদের উচিত ছিল কার্জন হলের মূল ভবন যেখানে বোস ২৪ বছর কাটিয়েছেন সেটাকে ‘বোস বিল্ডিং’ বা ‘বোস ভবন’ হিসেবে নামকরণ করা বা ওই রাস্তাটি ‘বোস সড়ক’ নামকরণ করা। কার্জন হলের সামনে বোসের একটি ভাস্কর্য থাকতে পারত।

আমাদের উচিত ছিল এই দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালন করা। বোসকে কদর করার মাধ্যমে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই ভাবনা ঢুকাতে পারতাম এই মাটিতে বসেও বিশ্বসেরা সব গবেষণা সম্ভব।

মহান বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে জানাই শুভ জন্মদিন।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়