উদ্যোক্তা শব্দটা ছোট হতে পারে, কিন্তু এর ওজন অনেক। তাই কেউ শখের বশে উদ্যোক্তা হতে চাইলে প্রথমেই তাকে নিষেধ করি। উদ্যোক্তা হয়ে উঠার কিছু প্রক্রিয়া আছে। প্রথমেই তাকে মাইন্ড-সেট করতে হবে। ভুলেও চিন্তা করা যাবে না, বাজার থেকে কিছু কাপড় কিনে এনে অনলাইনে বিক্রি করেই উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব।

প্রতিটা উদ্যোগের পিছনে নির্দিষ্ট একটা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। সোশ্যাল মেসেজ থাকতে হবে; বা কোনও সমস্যার সমাধান। আইডিয়াটা হওয়া উচিৎ অন্যদের চাইতে ইউনিক। তার জন্য সবার আগে মার্কেটটা জরিপ করা প্রয়োজন। জানা দরকার কি ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করলে উদ্যোগটা সফল হবে। আর অবশ্যই সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন।

প্রত্যেকের উচিত একটা বিজনেস প্ল্যান নিয়ে আগানো। পাশাপাশি কিছু বিষয় সম্পর্কে ছোট ছোট কর্মশালা করতে পারলে ভাল। যেমন: ডিজিটাল মার্কেটিং, ফাইনান্স, কাস্টমার মানেজম্যান্ট ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, প্রথম ৬ মাস বা ১ বছরে কোনও ধরনের রিটার্ন আশা না করা। ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং অবশ্যই সৎ থাকতে হবে। তবে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। মনে সাহস নিয়ে শুরু করাটা অনেক বড় ব্যাপার।

উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে গেলে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে, কিন্তু সেটা উতরে উঠা তেমন কঠিন কিছু না। মনে সাহস রাখতে হবে। নারীদের প্রতিবন্ধকতা অনেক। একটা সময় ছিল যখন পরিবার থেকে সাপোর্ট পাওয়া যেত না। এখন সেই জায়গাটা বদলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সিদ্ধান্তহীনতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে নিজের দক্ষতার উপর আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। প্রাথমিক ভাবে পুঁজি একটা বড় সমস্যা। সেটার জোগান নিজের জমানো টাকা থেকে হতে পারে। পারিবারিকভাবে কিছু সাপোর্ট নিতে পারেন। কিন্তু প্রথমেই ভুলেও ঋণের কথা চিন্তা করবেন না। আর আপনি চাইলেও উদ্যোগের সাথে সাথেই কোনও ব্যাংক বা ব্যক্তি আপনাকে ঋণ দিবে না। তাই প্রথমেই ফান্ডিং’র একটা ব্যবস্থা করেই নামা উচিৎ।

প্রতিটা উদ্যোগের পিছনে নির্দিষ্ট একটা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। সোশ্যাল মেসেজ থাকতে হবে বা কোনও সমস্যার সমাধান। আইডিয়াটা হওয়া উচিৎ অন্যদের চাইতে ইউনিক।

উদ্যোগ অনলাইনে হোক বা অফলাইনে, আপনাকে অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্স করে ফেলা উচিৎ। যদি যৌথ মালিকানা থাকে, তাহলে অবশ্যই আরজেএসসি Registrar of Joint Stock Companies And Firms (RJSC) থেকে রেজিস্টার করে ফেলা ভাল। কারণ যৌথ মালিকানায় কাগজপত্র সঠিক না হলে ভবিষ্যতে অনেক বেশি সমস্যায় পরতে হয়। এটাও আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মনে রাখবেন, যেদিন থেকে আপনি ট্রেড লাইসেন্স করবেন, সেদিন থেকে আপনার উদ্যোগের বয়স ধরা হবে। একজন উদ্যোক্তার জন্য উদ্যোগের বয়সটা অনেক জরুরি। কারণ আপনি পরবর্তীতে সরকারের কোনও সহায়তা পেতে গেলে বা ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে বা টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে গেলে, প্রতিটি জায়গায় আপনার উদ্যোগের বয়স সবার আগে দেখা হবে। তাই উদ্যোগের শুরুতেই এটা করে ফেলা ভাল। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে ব্যাংক একাউন্ট খুলে ফেলা। যেকোনো লেনদেন, তা যতই ছোট হোক না কেন, চেষ্টা করবেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার জন্য।

২০২০ এ আমাদের দেশে অনলাইনে হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে পরিকল্পনা ছাড়া। কেউ পরিবারকে চালানোর জন্য, কেউ অলস সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য, কেউবা অফলাইনের ব্যবসাতে বিরাট লস গুণে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন। মূল বিষয় হলও করোনা মহামারী। অনেক নারী আছেন, যারা কিনা কখনো ভাবেননি যে তারা কখনো উদ্যোক্তা হবেন। তাদের সংসার মোটামুটি হয়ত ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনায় অনেকের স্বামীর চাকরি চলে গেল, অনেকের চাকরি থাকলেও বেতন বন্ধ হয়ে গেল। সেই সময় উনারা কোনও না কোনোভাবে ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) গ্রুপে জয়েন করেন। সেখানে দেখেন মেয়েরা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে, যার যা দক্ষতা-যোগ্যতা আছে সেটা নিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। এসব দেখে তখন সেইসব নারী পরিবারকে বাঁচাতে নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগালেন। এমন অনেক ধরনের পণ্য আছে যা কিনা আমরা ভুলতে বসেছিলাম বা আমাদের পরের প্রজন্ম নামও শুনেনি, সেইসব পণ্য নিয়ে মানুষ উদ্যোক্তা হয়ে গেছেন এই করোনা মহামারীর সময়ে।

করোনা মহামারীর সময় প্রথম ধাক্কা আসলো বৈশাখে। বৈশাখকে কেন্দ্র করে অনেক ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করেছিল। তারা সবার বিনিয়োগ আটকা পড়ল। সেইসময় ব্যক্তি-পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাইকে উৎসাহিত করতে লাগলাম। ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) গ্রুপে হতাশামূলক পোস্ট দিতে নিরুৎসাহিত করলাম। সবাইকে বলতে লাগলাম আপনারা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। এইটাই সময়। এসব নিয়ে আমরা ওয়েবিনারও করলাম। সবার উৎসাহ অনেকগুণে বেড়ে গেল। তখন আমরা কিছু ফ্রি স্কিল ডেভেলপমেন্টের কাজ হাতে নিলাম।

উদ্যোক্তা হতে গেলে অন্যের ভালো সহ্য করার ক্ষমতা থাকাটা জরুরি। অনেক নারী উদ্যোক্তা এভাবে হারিয়ে যান।

এরমধ্যেই রোযা এবং ঈদের মার্কেটে যেন ধ্বস না নামে তার জন্য আমরা ই-ক্যাব (ই-কমার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ) এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলাম। তখন ই- কমার্স সেক্টরকে সরকার ইমারজেন্সি সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা অনুরোধ করলাম সরকারকে যে, ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করছেই, এই করোনায় তারা রিয়াল ফাইটার হয়ে কাজ করছে। তাদের সার্ভিসটা যদি রাত ১০টা পর্যন্ত বাড়ানো যেত এবং আমাদের অনলাইনের উদ্যোক্তাদের কাজ করার অনুমতি যদি পাওয়া যেত, তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা একটু বাঁচতে পারতো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বুঝলেন এবং আমাদের ডাকে সাড়া দিলেন।

সেই থেকে শুরু। তারপর আমাদের উদ্যোক্তাদেরকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। করোনা মহামারীর সময় লকডাউন চলাকালীন আমাদের ৩০০ জন উদ্যোক্তা লাখপতি খেতাব পেয়েছেন।

উদ্যোক্তা হতে গেলে অন্যের ভালো দেখার ক্ষমতা থাকাটা জরুরি। অনেক নারী উদ্যোক্তা এভাবে হারিয়ে যান। হেরে যাওয়া মেনে নিয়ে নতুন করে শুরু করার প্রবণতা নারীদের কম। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা নিয়েছেন। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং’র ব্যবস্থাও করা হয়। এছাড়াও আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে স্টার্টআপদের অনুদান দেওয়া হয়। সেখানে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তবে সরকারি পর্যায়ে এসব উদ্যোগ আরও বাড়াতে পারলে ভাল। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায় থেকেও নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা আসা উচিত বলে আমি মনে করি।

বর্তমানে এফ-কমার্স সেক্টর অনেক জনপ্রিয়। মহামারীর ভিতর এইখাতে ৩০০-৩৫০ কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। প্রায় ৬০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা এই খাতে। এই খাত যেন আরও বড় হয়, তার জন্য নারীদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি, নারীদের টিকে থাকার উপর অনেক গুরুত্বারোপ করা উচিৎ। বর্তমান বিশ্ব করোনাকে সাথে নিয়ে যেভাবে চলছে, এটাকে নিউ নরমাল ধরে নিয়ে আমাদের সকল নারীদেরকে টিকে থাকার মনোবল বৃদ্ধি করে এগিয়ে যেতে হবে।

নাসিমা আক্তার নিশা ।। প্রেসিডেন্ট, ওমেন অ্যান্ড ই–কমার্স ফোরাম (উই)

nishabd2012@gmail.com