ছবি : সংগৃহীত

প্রায় দেড় দশক আগে ছোট্ট একটা কবিতা পড়েছিলাম; গণস্বাস্থ্য সংস্থার চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কবিতাটি। সাময়িকীর তথ্য মোতাবেক, কবিতার রচয়িতা কৃষ্ণাঙ্গ এক শিশু। সত্যিই কোনো কালো রঙের আফ্রিকান/আমেরিকান শিশু লিখেছে কি না সে বিষয়ক তথ্য প্রমাণ যাচাই করা হয়নি কখনো। কিন্তু আজও মনে পড়ে কবিতাটির করুণ কণ্ঠস্বর; শিশুটি বলছে, আমি যখন জন্মাই তখন আমি কালো, যখন আমি হাসিখুশি, তখনো আমি কালো, আমি যখন অসুস্থ তখনো আমি কালো, কিন্তু তোমরা যখন জন্মাও তখন তোমরা গোলাপি, যখন তোমরা ভয় পাও তখন তোমরা সাদা, যখন তোমরা অসুস্থ তখন তোমরা ধূসর, এই তোমরাই আমাদের বলো বর্ণদুষ্ট! হ্যাঁ, এভাবেই সাদা শিশুদের প্রতি ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল করুণ ও মায়াবী প্রশ্ন; যে প্রশ্ন সম্ভবত এখনো ফুরিয়ে যায়নি। 

খোদ আমেরিকার বুকের মধ্য থেকে প্রায়শই খবর বের হয়, শ্বেতাঙ্গ আক্রমণে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ যুবক; তারই প্রতিক্রিয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠে আমেরিকা। পৃথিবী খ্যাত শিল্পী ও চলচ্চিত্র তারকাকেও আমেরিকায় জাতিবাদের কবলে পড়তে হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা এই সত্যই হাজির করে যে, মানুষের চিন্তা ও প্রায়োগিক দুনিয়া থেকে বর্ণবাদ বিদায় হয়ে যায়নি। বড়জোর এখন হয়তোবা রেসিজমের জায়গায় মোলায়েম করে বলা হয়ে থাকে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য। এই বাস্তবতায় সর্বকালের জন্য একটি নাম খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে—মার্টিন লুথার কিং। 

হ্যাঁ, কবিতার ওই শিশুটির মতো কৃষ্ণাঙ্গ তিনি। শত শত বছর ধরে সাদা আধিপত্যে বড় হয়ে ওঠা অগণিত কালো শিশুর একজন। তারও মনে হয়েছিল বর্ণের কী দোষ। কিন্তু ঔপনিবেশিক সাদা প্রভুদের মনে এই প্রশ্ন জাগেনি। বরং মানব সভ্যতার ইতিহাসে সাদারাই কালোদের বানিয়ে তুলেছে দাস, চাবুক হাঁকিয়ে শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়েছে, দাস বাজারে বিক্রি করেছে পশুর মতো, নারীদের ওপর চালিয়েছে যৌন সহিংসতা। 

আমি যখন জন্মাই তখন আমি কালো, যখন আমি হাসিখুশি, তখনো আমি কালো, আমি যখন অসুস্থ তখনো আমি কালো, কিন্তু তোমরা যখন জন্মাও তখন তোমরা গোলাপি...

পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কালোরা নানা পথে এসব থেকে মুক্তি খুঁজেছে। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের বর্ণগত ঐক্যকে সামনে রেখে গড়ে তোলা হয়েছিল নেগ্রিচুড মুভমেন্ট (Negritude movement); যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেনেগালের রাষ্ট্রপতি ও কবি লিওপোল্ড সেঁদর সেঙ্ঘর, মার্তিনিকের কবি এইমে সেজায়ার।
খোদ আমেরিকায় বসে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মার্টিন লুথার কিং। নাহ, তিনি কবি ছিলেন না; ছিলেন সমাজ সেবক; একজন যাজকও ছিলেন তিনি। তার আন্দোলন সারা বিশ্বে নাগরিক অধিকার আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। তিনি বিশেষভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার ও দাবি। 

১৯৫৫ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত শ্রম ও ঘামে একাকার হয়ে আমেরিকার পথে পথে ঘুরেছেন লুথার কিং; লক্ষ্য, জাতিগত ঐক্য, সমতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য মুক্তি ইত্যাদি। একবার তার মনে হয়েছিল, তিনি কি কৃষ্ণাঙ্গ পক্ষপাতের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছেন? আত্মসমালোচনার পথ ধরে এটাও বুঝেছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ উভয় শ্রমজীবী গোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়িত। অর্থাৎ, একদিকে বর্ণগত পরিচয় সামাজিক ও জাতিগত শোষণের উৎস, আবার বর্ণগত পরিচয় সমরূপ হওয়া সত্ত্বেও কাজ করছে না শ্রেণি শোষণের ক্ষেত্রে। এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন কার্ল মার্কসের কাছ থেকে।

অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, খ্রিস্টীয় বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত একজন যাজক হয়েও তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন হেগেল, স্টুয়ার্ট মিল, বেন্থাম, কার্ল মার্কস, নিটশে। প্রত্যেককে পড়েছেন গ্রহণ ও বর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে। মার্কসের কাছ থেকে শ্রেণি শোষণের শিক্ষা পেলেও তিনি মানুষের ওপর সাম্যবাদী রাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করতে পারেননি। মার্কসবাদের বিরোধিতায় প্রয়োজনের চেয়ে খানিকটা বেশিই খগড়হস্ত হয়েছিলেন লুথার কিং। নাস্তিকতার অজুহাতে সাম্যবাদকে অস্বীকার করেছিলেন। সাম্যবাদের ভেতর দেখেছিলেন মিথ্যা, প্রতারণা, আইন ভঙ্গ ইত্যাদি। কিন্তু নিপীড়িত শ্রেণির লড়াইয়ে মার্কসবাদের সামগ্রিক ঐতিহাসিক লড়াই তিনি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

পুঁজিবাদী শাসনের নিপীড়ক ভূমিকাকে সরাসরি বর্জন করেছেন কিং। নিটশের প্রেমহীনতা তাকে শান্তি দেয়নি। কারণ কিং-এর মর্মে আছে যিশুর প্রেমময় বাণী। যিশুই ছিলেন তার ধ্যান ও জ্ঞান। তার সঙ্গে মিলেছে ভারতীয় উপমহাদেশের চিন্তা বীজ। প্রবলভাবে আকৃষ্ট হলেন মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ, অহিংস নীতির প্রতি।

গান্ধীর বাণী ও ব্যাখ্যা শুনে ওই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিলেন গান্ধী বিষয়ক ডজন খানেক বই কিনে। দিনের পর দিন পড়ে রপ্ত করেছেন গান্ধীর মত ও পথ। মার্টিন লুথার কিং-এর জীবনে যিশু যদি হন তত্ত্ব ও বাণী, গান্ধী হলেন কর্মপন্থা।

এক স্মৃতি লেখায় বলেছেন, গান্ধীর বাণী ও ব্যাখ্যা শুনে ওই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিলেন গান্ধী বিষয়ক ডজন খানেক বই কিনে। দিনের পর দিন পড়ে রপ্ত করেছেন গান্ধীর মত ও পথ। মার্টিন লুথার কিং-এর জীবনে যিশু যদি হন তত্ত্ব ও বাণী, গান্ধী হলেন কর্মপন্থা। এই দুইয়ের সেতুবন্ধনে এগিয়ে গেলেন কিং।
প্রথমেই তিনি বুঝে নিলেন, সত্যাগ্রহ ও অহিংসার পথগুলো। নানা মুনির নানা প্রশ্ন। অহিংসা মানে কি নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থেকে অন্যের মার খাওয়া? রক্তের বদলায় রক্ত নিতে সমস্যা কোথায়? অহিংসা দিয়ে কি সামগ্রিক মুক্তি সম্ভব? কিং প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজেছেন নিজস্ব প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি দিয়ে।

আঘাত বা ঘৃণা দিয়ে নয়, আলাপ-সংলাপের ভেতর দিয়ে ঢুকতে চেয়েছেন প্রতিপক্ষের হৃদয়ে। এই প্রত্যাশা, পাষাণের হৃদয় যদি গলে। গান্ধীও এভাবে ভেবেছিলেন, দেশ জুড়ে বিশাল জমায়েত করতে পেরেছিলেন, তার ডাকে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল উদ্বেলিত জনতা। সেই সূত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্যারিশম্যাটিক নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন গান্ধী; তার সারল্য, তার হাসি, তার সাধারণ পোশাক মিলিয়ে গান্ধী হয়ে উঠেছিলেন আইকনিক চরিত্র। আমেরিকায় মার্টিন লুথার কিং তেমনই এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। লাখ লাখ কালো যেমন তাকে সমর্থন জানিয়েছিল, তার ডাকে সাদারাও নেমেছিলেন পথে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল নতুন বিশ্বমোড়ল। উন্নয়নের ধারণা দিয়ে উপনিবেশ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশ ও অঞ্চলসমূহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে, ভিয়েতনামে যুদ্ধ করছে, রাশিয়ার সঙ্গে ঠাণ্ডা লড়াইয়ে মত্ত। আর এ ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি মার্কিন শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্তের সমর্থন ছিল কম।

সংগত কারণে লুথার কিং নিজেও ছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে রাষ্ট্রের নিপীড়ক চরিত্রের সমালোচক। সবাইকে তিনি কাছে টেনে নিতে চাইলেন প্রেম ও ক্ষমা দিয়ে। কারণ যিশু ক্ষমা ও ভালোবাসার কথা বলেছেন। লুথার কিং-এর লেখায় বারবার ফিরে এসেছে ক্ষমা ও প্রেমের প্রসঙ্গ; শত্রুকেও কাছে টেনে নিতে চেয়েছিলেন তিনি।

১৯৬৪ সালে নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘সভ্যতা ও হিংসা হচ্ছে পরস্পর বিরোধী ধারণা।’ প্রতিহিংসা, আক্রমণ ও প্রতিশোধ বর্জন করে সম্পর্কের পথ খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছিল প্রেমই সেই পথ।

নেতা হিসেবে লুথার কিং-এর চরিত্রের কয়েকটি দিক আমাকে মুগ্ধ করে, সেগুলোর প্রথমেই আছে তার সহনশীলতা—অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা।

মার্টিন লুথার কিং-এর প্রতি আমার আগ্রহ প্রধানত ব্যক্তিক। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, অঞ্চল নিরপেক্ষভাবে মানুষকে কাছে টানার আকুল প্রয়াস যাদের মধ্যে দেখতে পাই, ব্যক্তিগতভাবে তাদের জীবন ও কর্মের পাঠ নিতে আমি আগ্রহ বোধ করি। নেতা হিসেবে লুথার কিং-এর চরিত্রের কয়েকটি দিক আমাকে মুগ্ধ করে, সেগুলোর প্রথমেই আছে তার সহনশীলতা—অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা। ক্ষমতার বিকার ব্যক্তির ভেতর থেকে এই উপাদানগুলোকে নিমেষেই হাওয়া করে দেয়। অথচ সত্যিকার গণতান্ত্রিক, মুক্তমত নির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এইসব কোনো বিকল্প হতে পারে না। সারাটি জীবন এই কথাগুলোই আওড়ে গিয়েছেন লুথার কিং।

কিং স্বপ্ন দেখতেন; নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন, সমতাভিত্তিক জীবনযাপনের স্বপ্ন। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্টে ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়ালে দিয়েছিলেন পৃথিবী সেরা বক্তৃতা, ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম।’ স্বপ্নের মতোই কাব্যিক তার বক্তৃতা। কিন্তু বাস্তব সত্যকে আড়াল করে সেই স্বপ্ন গড়ে ওঠেনি। আমেরিকার একশ বছরের ইতিহাস সামনে রেখে বলেছেন, ‘একশ বছর পরেও আমেরিকার সমাজের এক কোণে নিগ্রোরা অবসন্ন হয়ে পড়ে আছে এবং আপন দেশে নির্বাসিতের জীবন যাপন করছে।’ এই বাস্তবতায় কিং-এর স্বপ্নটি কেমন?

কিং স্বপ্ন দেখতেন, জর্জিয়ার লাল পাহাড়ের চূড়ায় সাবেক দাসদের সন্তান এবং সাবেক দাস মালিকের সন্তানেরা একই সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পাশাপাশি বসবে। মিসিসিপি পরিণত হবে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের মরূদ্যানে। গায়ের রং দিয়ে বিচার করা হবে না মানুষের পরিচয়।

হিংস্র জাতিবিদ্বেষী অধিকৃত আলবামায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা এক সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলবে। উঁচু পাহাড়গুলো নিচু হয়ে যাবে, অসমান ভূমিগুলো সমান হয়ে যাবে—দূর হয়ে যাবে মানুষে মানুষে অসমতা। আর স্বপ্নের শীর্ষবিন্দু—সেই আমেরিকা, সাদায় কালোয় ক্যাথলিক প্রটেস্টান্ট ইহুদি অ-ইহুদিতে মিলে বৈচিত্র্যের ঐক্য নিয়ে গড়ে ওঠা আমেরিকা—মহান আমেরিকান জাতি।

স্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে। আমেরিকা জাতি হিসেবে মহান হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই মহান আমেরিকার বুকের ভেতরই লুটিয়ে পড়েছিল মার্টিন লুথার কিং-এর দেহ। আততায়ীর গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে গেঁথে গিয়েছিল তাকে।

এই মহান আমেরিকাই বিশ্বের শীর্ষতম যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সে শত্রু ও বন্ধু বানায়। প্রতিদ্বন্দ্বীকে মুছে ফেলে। প্যাট্রিক লুমুম্বা, এমিলকার কাবরাল, সালভেদর আলেন্দেরা হারিয়ে গিয়েছেন মার্কিন মদদে। মার্কিন মাটিতে বসে শ্বেতাঙ্গ রাজনীতি ও সন্ত্রাসের বিরোধিতা করা লুথার কিংও হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো বহুবার হত্যার উদ্যোগ নিয়েছে; শেষ বেলায় সফল হয়েছে ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল। নেতার মৃত্যু অনেক ক্ষেত্রে আদর্শেরও ইতি ঘটায়। ইতি ঘটেছে লুথার কিং-এর আন্দোলনের। কিন্তু এখনো আমেরিকার জনসংস্কৃতিতে কিংবদন্তি তিনি; এখনো কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা কিং-এর স্মরণে কবিতা লেখে, তাদের স্মৃতিতে থাকে কিং-এর সেই স্বপ্নগুলো।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়