আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কথা বলতে গিয়ে দর্শক দেখে থমকে গেলাম। ছোট কিন্তু ‘বিশাল’ দর্শক সারি। এদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো, 'You can do it'!

এরা বেশিরভাগই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পিএইচডি এদের কাছে জলভাত। এরপরেও তাদের ডিগ্রীর সংখ্যা অসংখ্য। এদের মধ্যে বসে আছেন, নামকরা গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, আর আমি এদের শিখাবো, 'You can do it'?

এরা তো যা করার তা করে আরও হাজার হাজার মাইল এগিয়ে আছেন। জীবনে এই প্রথম পা কাঁপতে লাগলো। তারপরও ডায়াসে গেলাম। বোধিবৃক্ষের মত শিক্ষকরা অপেক্ষা করছেন প্রাচ্যদেশীয় এ ঘোর কৃষ্ণবর্ণের যুবক কি বলে তা শোনার জন্য। কেউ কেউ নিজের প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে এসেছেন। কারো হাতে নোট বুক। লিখবেন। শুধু আমিই বুঝতে পারছি না, এদের উপদেশ দেয়ার আমি কে?

এ যেন পেয়ারা গাছ, বটগাছকে বলছে, ‘বড় হও।’

মাইক্রোফোনের সামনে আসার পরই কে যেন একদম ভেতর থেকে কথা বলে উঠলো, ‘ইউ ক্যান নট ডু ওনলি, ইউ ক্যান চেইঞ্জ। চেইঞ্জ থ্রু কাইন্ডনেস।’

ইয়েস, ফ্রেন্ডস, উই হ্যাভ গট হোয়াট উই ডিজার্ভ, ইভেন উই হ্যাভ গট হোয়াট উই ডোন্ট ডিজার্ভ। নাও লেট আস পে ব্যাক।’

জীবনে এই প্রথম পা কাঁপতে লাগলো। তারপরও ডায়াসে গেলাম। বোধিবৃক্ষের মত শিক্ষকরা অপেক্ষা করছেন প্রাচ্যদেশীয় এ ঘোর কৃষ্ণবর্ণের যুবক কি বলে তা শোনার জন্য।

জীবনে যা আমাদের দরকার ছিল, তা আমরা পেয়েছি। এমন কি যা দরকার ছিল না তাও পেয়েছি। এখন ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আপনারা অনেক কিছুই করতে পারেন, যা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। এই পৃথিবী একজন মানুষকে যা দিতে পারে সবই আপনাদের দিয়েছে। খ্যাতি, অর্থ, সম্মান সব। এখন আপনারা যা করতে পারেন, তা হল, ঋণ পরিশোধ, দুনিয়ার ঋণ। আর তা একমাত্র সম্ভব দয়ার্দ্র হৃদয় দিয়ে। ভালোবাসা দিয়ে। ইউ ক্যান ডু ‘অ্যাক্ট অব কাইন্ডনেস।’

আপনারা মায়া ছড়াতে পারেন। এটাই একমাত্র বাকি যা আপনারা করতে পারেন। অন্য সব করা হয়েছে। কিন্তু এটা না করলে অন্য সব অর্জন বৃথা। এটা না করলে মানুষ হিসেবে আমরা ব্যর্থ।’

আমি অনুভব করছি, আমি না, আমার ভেতর থেকে কথা বলছে অন্য কেউ। আমার মনে পড়ছে আমার জননী জন্মভূমির সে-ই সব অসাধারণ মানুষের কথা, যারা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন অন্যের জন্য। যার টাকা আছে তিনি তা দিচ্ছেন, যার মেধা আছে তিনি তাই বিলিয়ে যাচ্ছেন, যার কিছুই নেই তিনি রক্ত জল করা শ্রম দিচ্ছেন। আমার দেশের কতো বদনাম, কতজন কত কথা বলেন, কিন্তু কেউ এসব মানুষের কথা বলেন না, যাদের ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে-

‘আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে।’

আমরা কি ফেনীর মোহাম্মদ নেসারের কথা জানি? তরুণ এ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার সারাদিন চাকরি শেষে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে বছরের পর পর বছর অজ্ঞাত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। নিজের বেতনের টাকায়। একে ওকে ধরে হাসপাতালে এসব অসহায় মানুষের জন্য আলাদা মেডিসিন কর্নার গড়ে তুলেছেন, যেখান থেকে তারা বিনামূল্যে ওষুধ পান। অসহায় অচেতন একজন রোগী, যার স্বজন কাছে নেই, নেসার ছেলে কিংবা ভাইয়ের মমতায় তার পাশে থাকেন দিনের পর দিন। এভাবে তিনি গত কয়েক বছরে প্রায় আটশো অজ্ঞাত রোগীর সেবা করেছেন।

সানজানা শিরিনের নাম কি উচ্চারিত হয়?  হবিগঞ্জের এ তরুণী মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। অনেক বছর ধরে নিজের তৈরি একটি মিশনে নেমেছেন। তা হল একজন রোগীকেও রক্তের অভাবে তিনি মারা যেতে দেবেন না। সামান্য বেতনকে সম্বল করে পুরো সিলেটে তিনি গড়ে তুলেছেন রক্তদাতাদের নেটওয়ার্ক। তার হাত ধরেই অতি দরিদ্র অসহায় রোগীরা জীবন ফিরে পাচ্ছেন।

পুলিশ কনস্টেবল শওকত তার বন্ধুদের নিয়ে ছোট্ট একটি দল গড়ে তুলেছেন যাদের কাজ হচ্ছে, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষ, দুর্গন্ধে যার কাছে যাওয়া যায় না তার সেবা করা, হাসপাতাল পৌঁছে দেওয়া।

বাংলাদেশ তস্করের মানচিত্র নয়, এটা হচ্ছে অসীম কুমার রায়ের দেশ, যিনি জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করে গ্রামে শুধু স্কুল গড়ে তোলেননি, সেখানে যে দু’শো বাচ্চা পড়াশোনা করে তাদের খরচও তিনি বহন করেন। কারো মাথার উপর ছাদ না দেখলে এ পঁচাত্তর বয়সী মানুষটির ঘুম ছুটে যায়, তাই জমানো সঞ্চয় ভেঙে তিনি তেতাল্লিশটি পরিবারের মাথার ওপর ছাদ বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি না থাকলে হয়তো এসব গৃহহারা মানুষের আশ্রয় হতো গাছতলা।

বাংলাদেশ হচ্ছে, মোহাম্মদ ওয়াহেদ হোসেনের দেশ, যিনি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অবসরে গিয়ে বিপন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে একটি অসম লড়াইয়ে নেমেছেন, তার সাথে লড়াই করছে ইকবাল তানজির, সায়মা আকতারের মতো তরুণেরা। একইভাবে অপু মনিরুল, মোহাম্মদ এনামুল হক, প্রিয়তা বড়ুয়াসহ এক ঝাঁক তারুণ্য মরণপণ লড়াই করছেন দুস্থ মানুষের কাছে খাদ্য কিংবা ওষুধ পৌঁছে দিতে।

এরাই ‘বাংলাদেশ’। বিদেশে টাকা পাচারকারীরা ‘বাংলাদেশ’ নয়, আমাদের মাতৃভূমি এদের গর্ভে ধারণ করেনি। সে ধারণ করেছে ড. চন্দ্রনাথকে, যিনি আমেরিকায় আয়েশি জীবনযাপন না করে সেখানে রক্ত জল করা টাকা ব্যয় করছেন আমাদের অসহায় ছাত্রছাত্রীদের জন্য, গড়ে তুলেছেন ‘মানুষ মানুষের জন্য’ নামের ফাউন্ডেশন।

বাংলাদেশ তস্করের মানচিত্র নয়, এটা হচ্ছে অসীম কুমার রায়ের দেশ, যিনি জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করে গ্রামে শুধু স্কুল গড়ে তোলেননি, সেখানে যে দু’শো বাচ্চা পড়াশোনা করে তাদের খরচও তিনি বহন করেন... এরাই ‘বাংলাদেশ’।

সামনে বসা অতি জ্ঞানী মানুষগুলোকে আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমার দেশ নিয়ে হতাশ হবেন না, দয়া করে আমাদের ভুল বুঝবেন না, আমাদের দেশেই আছে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভরা শত শত সংগঠন, যাদের ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, কিন্তু মানুষের জন্য তারা শুধু ইচ্ছে শক্তি দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করছেন। আপনারা দয়া করে তাদের দেখানো পথেই হাঁটুন। এক জীবনে যা পাওয়ার সব আপনারা পেয়েছেন, এবার এসেছে মায়া ছড়ানোর পালা। এ যাত্রায় উপরে যাদের কথা বললাম, তাদের দেখাতো পাবেনই, এছাড়াও দেখা পাবেন, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের, যিনি চট্টগ্রামে অভুক্তদের জন্য দীর্ঘদিন লঙ্গরখানা চালাচ্ছেন, গড়ে তুলেছেন মুসাফিরখানা, বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র ‘হ্যালো হসপিটাল।’ সব তিনি করছেন ‘আলহাজ্ব শামসুল হক ফাউন্ডেশন’র ব্যানারে।

আমরা এদের কথা জানি না বলে ভাবি বাংলাদেশ স্বার্থপরতায় অস্তিত্ব হারাচ্ছে। আসলে তা নয়, অনেক মানুষ আমাদের চারপাশে আছেন যারা ‘স্বার্থ’ শব্দটির সাথেই পরিচিত নয়, কিন্তু তাদের নাম আমরা জানি না এবং জানি না বলেই ভাবি আমাদের দেশে নিঃস্বার্থ মানুষ নেই। এর বিপরীতে আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, এ ধারণা মিথ্যে। এধরনের ‘সাধু’ টাইপ মানুষে আমাদের চারপাশ ভর্তি। সমস্যা হলও আমরা তাদের খেয়াল করি না; কিন্তু যতোই অনুচ্চারিত থাকুন, আপনাদের কাছে এদের খবর পৌঁছে না, আপনারা পান দুর্বৃত্তপনার খবর। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা আপনারা পোষণ করেন। দয়া করে ওই সব দুর্বৃত্তদের দিয়ে বাংলাদেশকে বিচার করবেন না। বিচার করুন আমি যাদের কথা বলছি তাদের দিয়ে। এরাই আসলে আমাদের জাতীয় বীর, যাদের গান কখনো গাওয়া হয় না।

প্রকৃত বীর হচ্ছেন তানভীর শাহরিয়ার রিমন, যিনি কানেক্ট দা ডটস নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে যার কেউ নেই তার আপনজন হয়ে যাচ্ছেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ। একদল স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ৩৫ হাজার গাছ লাগিয়েছেন। এটা ভাবা যায়? এছাড়াও তিনি ও তার দল স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে গাছ ও বীজ দিয়ে যাচ্ছেন।

‘ড্রিমস ফর টুমরো’ এর প্রতিষ্ঠাতা জাবেদ পারভেজ প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করতে কত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন; কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য দমে যাননি। রাজশাহীর ‘এসো পড়তে শিখি’ এর উদ্যোক্তা নিশাত তাসনিম তো বাচ্চা মেয়ে, এ বয়সে সে তার চারপাশের বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে। সাথে আছে সিলেট ভিত্তিক সংগঠন ইনোভেটর’র সমন্বয়কারী ঈশিতা ঘোষ এবং ইয়ুথ অপরচুনিটিস’র ওসামা বিন নুর যৌবনের আনন্দ উপভোগ বাদ দিয়ে যেভাবে বিপন্ন মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন তার কোনও তুলনা হয় না।

আসলে বাংলাদেশ হচ্ছে এদের দেশ, যে দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য এক মুহূর্ত চিন্তা না করে জীবন বিসর্জন দেন, যারা নিজে না খেয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ান, বন্যায় ডুবে যাওয়া জনপদে এদেশের মানুষেরাই পানিতে শুধু মাথা ভাসিয়ে আরেকজনের সাহায্যে স্রোত অতিক্রম করে এগিয়ে যান, তার মাথায় থাকে খাবারের হাঁড়ি।

বাংলাদেশ হচ্ছে এদের দেশ, এদের মুখ মানেই বাংলাদেশ, এটি কোনও তস্করের দেশ নয়। আমার আয়নায় আমি কেবল এদের বাংলাদেশকেই দেখি।

বাদল সৈয়দ ।। সমাজকর্মী ও কথাসাহিত্যিক

badalsyed@yahoo.com