তৎকালীন বেদে সমাজ (সৌজন্য ব্রিটিশ লাইব্রেরি)

ঢাকার প্রাচীন বিষয়ে জানতে হলে ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকার সিভিল সার্জন ডাক্তার জেমস ফওনস নর্টন ওয়াইজ বা জেমস ওয়াইজ একমাত্র ভরসা। জেমস ওয়াইজ ছিলেন ব্রিটিশ ঢাকার প্রথম সিভিল সার্জন। ১৮৬৬ সালে ও ১৮৬৮ সালে কৃত জেমস ওয়াইজের দুটি রিপোর্টের কথা জানা যায়। সেখানে তৎকালীন ঢাকার পেশার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।  তার লেখা ‘নোটস অন রেসেস, কাস্টম অ্যান্ড ট্রেডস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল’ নামে একটি বই ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। কাজেই ধারণা করা যায় আঠারো শতকের ষাটের দশকে জেমস ওয়াইজ ঢাকার সিভিল সার্জন ছিলেন। ওয়াইজের তথ্য উপাত্ত থেকে এই ধারণায় পৌঁছানো যায়, মুঘল আমলেই ঢাকায় ব্যাপক বসতি এবং পেশার উদ্ভব।

ঢাকার ইতিহাস প্রণয়ন কমিটির অতি সন্নিকটে মান্ডা মসজিদের শিলালিপি থেকে আবিষ্কৃত তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় বসতির বয়স প্রায় ছয়শ বছর, আর শিলালিপির অপর পিঠের বিষ্ণুমূর্তি ধরে হিসাব করলে ঢাকার বয়স প্রায় হাজার বছর। তবে ঢাকায় ব্যাপক লোকবসতি ও ব্যাপক পেশাজীবীর উদ্ভব মুঘল আমল থেকে। সপ্তম শতকে ঢাকার লোকবসতি শুরু হলেও, ঢাকার কাছেই বিক্রমপুরে সেন রাজাদের রাজধানী ছিল। সে সময় ঢাকায় উল্লেখ করার মতো পেশা ছিল পুরোহিত। পরবর্তীতে তুর্কি ও আফগান শাসনাধীন ঢাকায় সংক্ষিপ্ত আকারে ইমাম ও হাজাম শ্রেণির আগমন ঘটে।

১৬০৮ সালে চৌকো বন্দরে মুঘল সেনাপতি ইসলাম খাঁ’র পা রাখার মধ্য দিয়ে ঢাকায় বসতি স্থাপনের গোড়াপত্তন শুরু হয়। ধারণা করা হয় রাজকীয় বাহিনীর প্রয়োজনেই বুড়িগঙ্গা পাড়ে জমে ওঠে নতুন জনসমাগম। মুঘল রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে সহিস, মাহুত, পাইক, পেয়াদা, গোমস্তা নানা সহায়ক শ্রেণি এসেছিলেন বাংলায়। এরা সাধারণত আফগান, ইরান ও পারস্যের নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ। এই বিশাল মুঘল বাহিনীর প্রয়োজনীয় শস্য, শাক-সবজিসহ নিত্য পণ্যের জোগান দিতে শুরু করেন আশপাশের বসতির চাষিরা। বসতে শুরু করে হাট-বাজার। বুড়িগঙ্গা তীরের ছোট পরিসরের চৌকো বন্দর সম্প্রসারিত হয়ে বাণিজ্যিক স্থানে রূপ নেয়।

বাণিজ্য দখলের জোরে জগতের নানা জাতি ভারতবর্ষ তথা বাংলা আক্রমণ করেছে। দখল করেছে এবং পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে লাভবান হয়েছে।

মুঘল রাজন্যবর্গ হেরেমে থাকতেন, তাদের হয়ে নিত্য কাজ-কর্ম সম্পন্ন করতেন চাকর-নকার-গোমস্তারা। কাজেই তাদের প্রয়োজনে নতুন নতুন পেশা সৃষ্টি হতে থাকে। যেমন প্রাথমিক পর্যায়ে সহিস, মাহুত, পাইক, পেয়াদা, গোমস্তা, বাত্তিওয়ালা, ভিস্তিওয়ালাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের পেশাগুলোর সৃষ্টি হয়।

রাজন্যবর্গের সাধারণের সঙ্গে মেশার কোন সুযোগ ছিল না। তাদের হয়ে কাজ করতো চাকর-নকার, সহিস-মাহুতরা। এসব নকার-চাকররা সময়ের পরিক্রমায় এবং সামাজিকতা রক্ষার প্রয়োজনে মৌখিকভাবে বাংলা ভাষা আত্মস্থ করার চেষ্টা করে। তাদের মুখের কথ্যভাষা নিজ মাতৃভাষার টানের কারণে কখনোই প্রমিত বাংলা হয়ে ওঠেনি। সেখানে একটি বিকৃত বা ব্যতিক্রমী ভাষার উদ্ভব হয়েছে। তাদের নিজস্ব ভাষা আর বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে একটি বিশেষ আঞ্চলিক ভাষার উদ্ভব হয়। যাকে আমরা ঢাকাই ভাষা বলি।

সাম্রাজ্য বিজয়ী শাসন মূলত শোষণ আর বাণিজ্য সম্প্রসারণের ইতিহাস। শাসন করা মানেই জনপদের সম্পদ লুণ্ঠন আর কুক্ষিগত করার কাহিনী। মুঘল কর্তৃক ঢাকা আগমনের মধ্যদিয়ে রাজকীয় মুঘল বাহিনীর প্রয়োজনে ঢাকায় গড়ে ওঠতে থাকে বাসস্থান, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা। মুঘল আমলের পূর্বে এশিয়া মাইনর এবং প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না। পর্তুগীজ, ফরাসি নাবিকেরা বাংলার হাট-বাজার ঘুরে চাষির উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করে। আবার কখনো বা নিজেরা অর্ডার বা জোর করে পণ্য উৎপাদন করিয়ে তা প্রাচ্যে বাজারজাত করতো, যেমন নীল। এই বাণিজ্য দখলের জোরে জগতের নানা জাতি ভারতবর্ষ তথা বাংলা আক্রমণ করেছে। দখল করেছে এবং পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে লাভবান হয়েছে।

বাংলা দখলের পর মুঘল শাসকরা এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উদ্যোগ নেয়। বাণিজ্য পরিকল্পনার অংশ হিসেবে উৎপাদিত পণ্যের কারিকরদের একত্রিত করার পরিকল্পনা করে তারা। ঠিক এখনকার রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের আদলে তারা ঢাকায় পেশাভিত্তিক মহল্লা গড়ে তুলেন। বলা যায়, ঢাকায় মহল্লা ভিত্তিক পেশার উদ্ভব এক রাজকীয় ঘটনা। রাজকীয় মুঘল পাদশাহি বা বাদশাহির প্রয়োজনে যেমন ঢাকায় পেশার সৃজন। একই ভাবে একেক পেশার মানুষকে এনে, একেক এলাকায় স্থাপন বা বসতি গড়ে তোলাও তাদের বাণিজ্য উচ্চাভিলাষের অংশ।

বিক্রমপুর থেকে শাঁখারীদের এনে প্রতিষ্ঠা করেন শাঁখারী বাজার। জানা যায়, এ অঞ্চলে শাঁখারীরা প্রথমে আসে রাজা বল্লাল সেনের সঙ্গে বিক্রমপুরে। বিক্রমপুরে বল্লাল সেনের প্রাসাদের কাছে একটি জায়গার নাম শাঁখারী বাজার। সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে নতুন শহরে নিষ্কর জমির লোভ দেখিয়ে পরিকল্পিতভাবে তাদের বিক্রমপুর ছাড়তে রাজি করানো হয় শাঁখারীদের।

চন্ডুওয়ালা, নৈচাবন্দ, সোনারু, পোদ্দার, কাসারু, বাখারিয়া, কুম্ভকার, খুন্দিগর, ওস্তাগার, ভিস্তিওয়ালা, কুনজিয়া, কলু, কুলু, গন্ধবণিক সহ নানা পেশার উদ্ভব হয়। ডা. জেমস ওয়াইজের সার্ভেতে তৎকালে ঢাকায় দুই শতাধিকের উপর পেশার প্রমাণ পাওয়া যায়।

বরিশাল থেকে ময়রাদের এনে প্রতিষ্ঠা করা হয় ময়রা পট্টি, বাজুনিয়াদের জন্য বাজুইন্নাপাড়া ইত্যাদি। এক সময়ের জগৎবিখ্যাত মসলিন শাড়ির কারিকর তাঁতিদের তাঁতিবাজার থাকলেও সেখানে আর জোলাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আর এসব পেশার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট ছিল তাঁতি বা জোলারা। ডা. জেমস ওয়াইজের বর্ণনায় ‘জোলাদের থেকে মুসলমান তাঁতিদের “কওম” স্বতন্ত্র। তাঁতিরা বানায় জামদানি বা নকশা তোলা কাপড়; আর জোলারা বানায় মোটা মসলিন।” আর সে সময়ের সবচেয়ে বাণিজ্য সফল পেশা তাঁতিদের বাস ছিল ডেমরায়। জেমস ওয়াইজ থেকে আরও জানা যায়, “ঢাকায় মুসলমান তাঁতই অসংখ্য। বিশেষ করে এরা বাস করে ডেমরার নবীগঞ্জ ও লক্ষ্যা নদীর পাড় বরাবর। ব্যবসা মন্দা মৌসুমে এরা হাল চাষ করে। কখনও তাঁতে কাপড় বোনেন এদের মেয়েরা। তার বদলে ওরা জামদানি চিকনের কাজ করে অর্থাৎ নকশা তোলে”।

এভাবে চন্ডুওয়ালা, নৈচাবন্দ, সোনারু, পোদ্দার, কাসারু, বাখারিয়া, কুম্ভকার, খুন্দিগর, ওস্তাগার, ভিস্তিওয়ালা, কুনজিয়া, কলু, কুলু, গন্ধবণিক নানা পেশার উদ্ভব হয় সে সময় এবং প্রতিটি পেশার মানুষ এলাকাভিত্তিক সমাজবদ্ধ বাস করতো।

ডা. জেমস ওয়াইজের সার্ভেতে তৎকালে ঢাকায় দুই শতাধিকের উপর পেশার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রশ্ন জাগতে পারে সে পেশাগুলো কি এখনো আছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা একটু সময় সাপেক্ষ। অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, মিজানুর রহমান এবং ঢাকায় বেড়ে ওঠা অন্যান্য লেখকদের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ পরবর্তী ঢাকার পেশার বিষয়ে। যেমন ঢাকার নৌকা কারিকর, ব্যান্ড পার্টি, চিনিঠিকরি -মোজাইক কারিকর, ওস্তাগার সহ সময়ের প্রয়োজনে নতুন এ সব পেশার সৃষ্টি হয় ঢাকায়।

ঢাকা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে এ সব পেশা কি এখনো আছে? বায়ান্ন বাজারের, তিপ্পান্ন গলি ঘুরে এই বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। মানুষের চাহিদার উপর ভিত্তি করে এবং সময়ের প্রয়োজনে সেই সব পেশা কদাচিৎ খুঁজে পাওয়া যায়। আর কালের বিবর্তনে সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু ভাষা অনেক পেশা নাম অথবা রূপ পরিবর্তন করেছে। যেমন বন্ধকীর ব্যবসা এখন ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়েছে। জোলাদের পেশা টিমটিম সোডিয়াম আলোতে চোখে পড়লেও, তা এখন স্পিনিং মিলের ঘারে। সহিস আর মাহুতদের রাস্তার দাপট এখন যান্ত্রিক গাড়ির ড্রাইভার আর হেলপারদের হাতে।

একটা অপ্রয়োজনীয় অথবা অতি প্রয়োজনীয় এবং দৃষ্টিপাত করার মতো বিষয়, এক সময় মগ, হার্মাদ আর জল দস্যুদের দখলে ছিল এই সব শিল্পের কাঁচামালের জোগান ব্যবস্থার চাকা। আর এখন শাসকশ্রেণির মদদপুষ্ট নব্য হার্মাদের দখলে শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের জোগান।

নব্য হার্মাদ, আর মুক্তবাজারের দাপটে বাংলার প্রাচীন এসব শিল্প আর শিল্পী-কারিকরদের টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। যারা টিকে আছেন অন্য পেশায় আধা সময় ব্যয় করে জীবন নির্বাহ করছেন। কেবল পূর্বপুরুষের শিল্পের মায়ায় লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রাচীন পেশার নাম। পূর্বের পাকিস্তান মাঠ, বর্তমান বাংলাদেশ মাঠের পাশেই আছে প্রাচীন এক পেশা খুন্দিগর বা পশুর শিং-এর শিল্প তৈরির প্রাচীন পরম্পরার সাক্ষী এক চরিত্র। এখনো যার দেখা মিলে। তবে প্রাচীন এই পেশাগুলো আমাদের ঐতিহ্য বহন করছে। পেশা বিলুপ্তির সাথে সাথে সেইসব ঐতিহ্যও মিলিয়ে যাচ্ছে আধুনিকায়নে।

তথ্যসূত্র:

  • কিংবদন্তির ঢাকা ।। নাজির হোসেন।
  • ঢাকা: ইতিহাস ও নগরজীবন ১৮৪০-১৯২১ ।। শরীফ উদ্দীন আহমেদ ।। একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি ২০০১।
  • হাজার বছরের ঢাকা ।। বৃহত্তর ঢাকা সাংবাদিক ফোরাম ২০২০।
  • ঢাকার প্রথম ।। মুনতাসির মামুন ।। অনুপম প্রকাশনী ২০১০।
  • বিক্রমপুরের ইতিহাস ।। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত।
  • নোটস অন রেসেস, কাস্টম অ্যান্ড ট্রেডস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল ।। জেমস ওয়াইজ।

ইমরান উজ-জামান ।। পরিব্রাজক ও গবেষক

imranbtv1@gmail.com