ছবি : সংগৃহীত

এক. 
অনেকগুলো পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে। প্রতিবছরই এসব সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনের উত্তাপ সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না কিংবা ছড়ায় না। কিন্তু এবার চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন ঘিরে সবার মধ্যে আগ্রহ-উত্তাপ দেখা গেছে। মনে হচ্ছিল, জাতীয় রাজনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তনের হাওয়া উড়ছে। কেন এই আগ্রহ, কেন এত মাতামাতি? এ প্রশ্নের সঠিক কারণ আমার কাছে নেই। অথচ একই দিন অভিনয় শিল্পী সংঘের নির্বাচনও হয়েছে। সেটা নিয়ে কিন্তু এত আলোচনা হয়নি। তাহলে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন ঘিরে এত আলোচনা কেন। ‘আসল ঘরে মশাল নাই ঢেঁকিঘরে চাঁদোয়া’—ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে মানুষ যখন অপ্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডে বেশি মনোযোগী হয়, তখন এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ শিল্পী সমিতির নির্বাচন ঘিরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ও সাধারণ মানুষের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ দেখে আমার এই প্রবাদটি মনে পড়ে গেল। হয়তোবা চলচ্চিত্রে বৈকল্য অবস্থার পরিবর্তনের জন্য এত আলোচনার জন্ম। যতোটা এসব নির্বাচন নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে, এগুলো সাধারণ একটা ব্যাপার, ক্ষুদ্র বিষয়। ভীষণ দুঃখজনক, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মানুষের এখন আর এত আগ্রহ নেই। 

দুই.
আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির দ্বিবার্ষিক (২০২২-২০২৪) নির্বাচন। নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন দর্শকপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। এবারের নির্বাচন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির যেকোনো নির্বাচনকে হার মানিয়েছে। বেশ অনেক কারণেই এবারের নির্বাচন নিয়ে সারাদেশের দৃষ্টি ছিল এফডিসির দিকে। যার অন্যতম কারণ নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ইলিয়াস কাঞ্চন ১৯১ ভোট পেয়ে মিশা সওদাগরকে হারিয়ে ৩৩ বছর পর শিল্পী সমিতির দায়িত্ব নিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, এ নির্বাচনে প্রকৃত ‘নায়কে’র জয় হয়েছে। 

ইলিয়াস কাঞ্চনকে বাংলা চলচ্চিত্রের এক ইতিহাস বলা চলে। তার ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক ব্যবসাসফল সিনেমা। শুধু এই সিনেমা নয়, তার আরও অনেক সুপার হিট ছবি আছে, যা দর্শকের মনে আজও জায়গা করে আছে। গ্রাম থেকে শহর— সবখানে ছড়িয়ে আছে তার ভক্ত। শুধু সিনেমা নয়, সামজিক নানা কর্মকাণ্ডের সাথেও তিনি জড়িত। তার গড়া ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ যেন সূর্য হয়ে কাজ করছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। শিল্পী সমিতির নির্বাচন করছেন ইলিয়াস কাঞ্চন খবরটি শুনে তাকে নিয়ে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। ট্রলও হয়েছে। সাধারণ দর্শকদের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের অনেকেই এবারের নেতৃত্বে তাকে চেয়েছেন। সব মিলিয়ে নির্বাচনে তার জয় হয়েছে। আমরাও আশা করব, নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যাওয়া এই ঋদ্ধ-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইলিয়াস কাঞ্চন নতুন দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবেন এবং সফল হবেন। 

শিল্পী সমিতি কেন, পরিচালক ও প্রযোজকসহ চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও যেসব সমিতি আছে, সেগুলোর কোনোটিই চলচ্চিত্র উন্নয়নের জন্য কোনো কাজ করছে না। তাহলে শিল্পী সমিতির এই নির্বাচন নিয়ে কলা-কুশলীদের এত উৎসাহ উদ্দীপনার কারণটা কী? জিজ্ঞাসা, ‘কী মধু এই শিল্পী সমিতির নির্বাচনে?’

তিন.
চলচ্চিত্র শিল্পের অবস্থা অত্যন্ত মন্দ। সহজভাবে বলা যায়- ধুঁকে ধুঁকে চলছে এই শিল্পটি। এখন আর নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার হলগুলোতে সিনেমা মুক্তি পায় না। দেশে নির্মিত সর্বশেষ কোন চলচ্চিত্রটি সুপারহিট বা ব্যবসাসফল হয়েছে, তার নাম বলতে গেলে অনেকেই আমতা আমতা করবেন। সে তালিকা বলতে হোঁচট খাবেন নিশ্চয়। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের নাম বলতে গিয়ে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্তরাও থমকে যাবেন কিছুক্ষণ। এ অবস্থায় একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো। কিন্তু এসব নিয়ে আমাদের প্রযোজক, পরিচালক, নায়ক-নায়িকা, চরিত্রাভিনেতা, ভিলেন, চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত কারোরই তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। তবে এবার তাদের উৎসাহব্যঞ্জক তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন উঠে আসছে কোনো না কোনো শিল্পীর নাম। এই সুযোগে নতুন প্রজন্ম অনেক শিল্পীর নাম জানার সুযোগ পাচ্ছেন, এটাও কিন্তু কম নয়। তো তাদের এই হঠাৎ জেগে ওঠার নানা কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম বাণিজ্য পরিভাষায় ‘বিপণন ব্যবস্থাপনা’। 

অন্ধকারাচ্ছন্ন ঢাকার চলচ্চিত্র মন্দার বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের সঙ্গীতাঙ্গনসহ পুরো সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। সর্বশেষ ঢাকার চলচ্চিত্রের কোন গানটা মোটামুটি কালত্তীর্ণ হয়েছে তা বলাটা সহজ না। অথচ একসময় দেশি সিনেমার গান লোকজনের মুখে মুখে ফিরতো। রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর, কবরী, শাবানা আর ববিতার মতো অভিনেত্রীদের লিপসিনে কণ্ঠ দিয়েই কিন্তু জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, আব্দুল জব্বার, সৈয়দ আব্দুল হাদী, এন্ডু কিশোরের মতো কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পীরা। কিন্তু অন্ধকার গহ্বরে পড়ে যাওয়া ঢাকার চলচ্চিত্রকে টেনে তোলার কেনো কার্যকর তৎপরতা চোখে পড়ে না। এ নিয়ে শিল্পী সমিতির নেতারা কার্যত কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন- এমনটা উল্লেখ পাওয়া যায় না। শুধু শিল্পী সমিতি কেন, পরিচালক ও প্রযোজকসহ চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও যেসব সমিতি আছে, সেগুলোর কোনোটিই চলচ্চিত্র উন্নয়নের জন্য কোনো কাজ করছে না। তাহলে শিল্পী সমিতির এই নির্বাচন নিয়ে কলা-কুশলীদের এত উৎসাহ উদ্দীপনার কারণটা কী? জিজ্ঞাসা, ‘কী মধু এই শিল্পী সমিতির নির্বাচনে?’

চার.
নির্বাচন ঘিরে নায়ক রিয়াজ তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। আবার নির্বাচনে প্রচারণার জন্য দুই প্যানেলই গান তৈরি করেছে। এর মধ্যে ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ প্যানেলের প্রচার করা গানটি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। এ গানের এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘নোট দিয়ে ভোট কেনার দিন শেষ।’ শিল্পী সমিতির নির্বাচনে টাকার কথা আসবে কেন? কিন্তু নির্বাচনের দিন জায়েদ খানের বিরুদ্ধে টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ উঠেছে। কিছু কিছু ভিডিওচিত্র ভাইরালও হয়েছে।

এসবের ভেতর দিয়ে শিল্পী সমিতির নির্বাচনের ভোট হয়েছে। অনেকেই এসেছিলেন ভোট দিতে। কিন্তু নির্বাচনের আগে আদালতের রায়ে ভোটাধিকার পাওয়া ১৮৪ জন শিল্পী শেষ পর্যন্ত ভোট দিতে পারেননি। কী করে! এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, রাজনীতিও হয়েছে। আসা যাক, সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে। জায়েদ খান বিজয়ী হয়েছেন, এরকম একটি ঘোষণা মধ্যরাতে এসেছে। প্রথম কথা, কাস্ট হয়েছে ৩৬৫ ভোট। এ ভোট গণণা শেষ হতে মধ্যরাত হলো কেন। তার চাইতে অনেক অনেক বিশাল বিশাল কাস্টিং ভোট গণনা শেষ হতে এতো লম্বা সময় লাগেনি, মধ্যরাত হয়নি। আর ‘মধ্যরাত’ শব্দটা মনে হলে কেমন যেন একটা খটকা লাগে। সাম্প্রতিককালে সিইসির ‘রাতের ভোট আমি দেখিনি’ কথা মনে পড়ে যায়। নিপুণের পরাজয় নিয়ে খটকা চলছে। নিপুণ একটি অভিযোগ উত্থাপনও করেছেন। অনেকেই সেটাকে সমর্থন করছেন। এ সমর্থনটা একদমই অমূলক বা অগ্রহণযোগ্য নয়। তবে এ বিষয়ে ইলিয়াস-নিপুণ প্যানেল সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চনের নীরবতা বিস্মিত করছে। এ প্যানেলের অভিভাবক হিসেবে তার নিপুণের পাশে থাকা উচিৎ ছিল।  

জয়-পরাজয়ের খেলায় ভোটের ব্যবধান বেশি নয়। তবে বেশ লড়াই করতে হয়েছে দুজনকেই। প্রশ্ন উঠেছে, জায়েদ খান কিভাবে নির্বাচিত হলেন? ফলাফল অনুযায়ী, জায়েদ খান পেয়েছেন ১৭৬ ভোট, নিপুণ পেয়েছেন ১৬৩ ভোট। অতএব, দুজনে মিলে পেয়েছেন ৩৩৯ ভোট। নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য অনুযায়ী ভোট কাস্ট হয়েছে ৩৬৫টি এবং ভোট বাতিল হয়েছে ১০টি। অর্থাৎ কার্যকরী ভোট: ৩৬৫-১০=৩৫৫টি। নিপুণ এবং জায়েদ খান মিলে মোট ৩৩৯ ভোট পেলে কার্যকরী ভোটের (৩৫৫-৩৩৯) ১৬টি ভোট কোথায়? নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে জোরালো নয়। আরেকটি বিষয়, এখানে আমি বড় করে প্রশ্ন রাখতে চাই, ভোটগ্রহণের কিছু সময়ের পর ভোট গণনার ফলাফল কিভাবে এলো? এ ফলাফলটা অনেকের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। কে বা কারা করেছে, তা জানি না। কিন্তু এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। 

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে নিপুণের পরাজয় হয়েছে, আপিলেও তা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন তাকে পরাজিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। নিপুণের পরাজয়, কিংবা শিল্পী সমিতির নির্বাচন, আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে? কী আভাস দিচ্ছে! জাতীয় নির্বাচন কিংবা স্থানীয় নির্বাচনগুলোর সাথে কী কোনো সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে?    

জাতীয় রাজনীতি একটা সংকটকাল অতিক্রম করেছে। আবার আমাদের শিল্পীরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন— তারা সমাজের আয়না।

পাঁচ.
প্রবীণ অভিনেতা আবুল হায়াত একটি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘শুধু অফিসে বসে থাকার জন্য নির্বাচন করলে হবে না। তহবিল চেয়ে নিজেদের ছোট করা ছাড়াও অনেক কাজ রয়েছে। যত্রতত্র অভিনয়শিল্পীদের কারণে নাটকের মান কমে যাচ্ছে। সেদিকে নজর দিয়ে নিয়মিত ওয়ার্কশপ করা যেতে পারে। অভিনয়শিল্পীদের কারখানা কীভাবে করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। সেইজন্য দক্ষ লোককেই বেছে নিতে হবে।’ কথাগুলো তিনি বলেছেন অভিনয় শিল্পী সংঘের নির্বাচনকে সামনে রেখে। তার এ কথাগুলোর মধ্যে অনেকদিনের হতাশা যেমন রয়েছে, নেতৃত্বের প্রতি তার অভিভাবকসুলভ পরামর্শও রয়েছে। দেখা যেতে পারে, নেতৃত্ব কতটুকু এসব উপলব্ধি করতে পারে। 

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি হোক বা অভিনয় শিল্পী সংঘ, এসব সংগঠন জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নয়, কার্যহীনতার কারণে এগুলো ভুঁইফোঁড় সংগঠনে পরিণত হয়। যখন এসব সংগঠন অর্থবহ-কার্যকরী ও সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে ওঠে, তখনই এটাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা যায়। মূলত, আমার কাছে, কিংবা রাষ্ট্রের কাছে শিল্পীরা জাতীয় ও মানুষের সাংস্কৃতিক-প্রগতিশীল জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে অবশ্যই স্মরণযোগ্য। 

রাজনৈতিক শূন্যতার ফলে চলচ্চিত্রসহ পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে; চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরম্পরায় সেটা স্বাভাবিক। জাতীয় রাজনীতি একটা সংকটকাল অতিক্রম করেছে। আবার আমাদের শিল্পীরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন— তারা সমাজের আয়না। সেই শিল্পীরা আগামী দিনে সমাজ প্রগতির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন- এটাই সবার আশা ও প্রত্যাশা। কাজ না পাওয়া কেউ কেউ বলেছেন, শিল্পী সমিতির উন্নতি চাই না, কাজ চাই। শিল্পী সমিতির উন্নতি না হলে কাজ হবে কিভাবে? অভিনয় শিল্পী সংঘ, শিল্পী সমিতি হোক, গোটা সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের এটা মাথায় রাখা উচিৎ।