চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংজ্ঞানুসারে ক্যান্সার এমন এক অসুখ যা কোনো বিধিনিষেধ মানে না। রক্ত কিংবা লসিকা (Lymph) স্রোতে ভেসে ভেসে অস্বাভাবিক গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এক অঙ্গ থেকে আরেক অঙ্গে। বাসা বাধে হাড়, ফুসফুস, যকৃত, মস্তিষ্কসহ আরও নানান জায়গায়। রোগীর চিকিৎসা শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্যান্সার তার এই অরাজকতা চালাতেই থাকে। তাই ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র হলো দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা।

মোটাদাগে ক্যান্সারের চিকিৎসা তিন ধরনের। সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীর এই তিন ধরনের চিকিৎসাই গ্রহণ করতে হয়। বাকি ৫০ শতাংশ রোগীর যেকোনো দুইটি বা একটি চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়। 

কিন্তু আমাদের দেশে রোগীরা ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করতে অনেক দেরি করে ফেলে। আবার শুরু করলেও ঠিক মতো ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে না। ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারার একটা বড় কারণ ক্যান্সার চিকিৎসা একটি দীর্ঘমেয়াদী ব্যয়বহুল চিকিৎসা। চিকিৎসার পুরোটা সময় জুড়ে অর্থ সংস্থান ঠিকঠাক না হলে চিকিৎসা পিছিয়ে পড়ে। 

প্রায়শই দেখা যায়, আমাদের সমাজের মধ্যবিত্তরা তার আপনজনদের ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করে কর্পোরেট হাসপাতালে আর শেষ করে সরকারি হাসপাতালে। এই পুরো পথ হাঁটতে গিয়ে তারা এক প্রকার নিঃস্ব হয়ে পড়ে। অপরদিকে নিম্নবিত্তরা ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করে কিন্তু শেষ করার আগেই সর্বস্ব খুইয়ে ক্ষান্ত হয়ে যায়।

প্রায়শই দেখা যায়, আমাদের সমাজের মধ্যবিত্তরা তার আপনজনদের ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করে কর্পোরেট হাসপাতালে আর শেষ করে সরকারি হাসপাতালে। এই পুরো পথ হাঁটতে গিয়ে তারা এক প্রকার নিঃস্ব হয়ে পড়ে।

২০২২, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের জন্যে বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘ক্লোজ দ্যা কেয়ার গ্যাপ’। এখন প্রশ্ন হলো এই গ্যাপটা আসলে কতটুকু?

সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া একটি গবেষণাপত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের গবেষক দল বলেছেন, বাংলাদেশে একজন ক্যান্সার রোগীর প্রতি বছরে গড়ে ৬ লাখ টাকা খরচ হয়। এই খরচের মধ্যে আছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ, অপারেশনের খরচ, রেডিওথেরাপির খরচ, কেমোথেরাপি তথা ওষুধের খরচ, চিকিৎসকের ফি, ক্লিনিক বা হাসপাতালের বেড ভাড়া, বাড়ি থেকে রোগী ও রোগীর সঙ্গীর চিকিৎসা কেন্দ্রে আসা-যাওয়া, থাকা ও খাওয়ার খরচ ইত্যাদি। অর্থাৎ, একজন ক্যান্সার রোগী তিন বছর বেঁচে থাকলে তার পেছনে খরচ হয় প্রায় ১৮ লাখ টাকা।

খরচ কিছুটা কমাতে চাইলে চিকিৎসার পুরোটা নিতে হবে কোনো সরকারি হাসপাতালে। সেখানকার ক্যান্সার রোগীদের কাছে আরেকটি দুঃস্বপ্নের নাম চিকিৎসা প্রাপ্তিতে অপেক্ষমাণ সারি। দীর্ঘ অপেক্ষমাণ সারি আছে সার্জারি করার ক্ষেত্রে, তারচেয়েও দীর্ঘ সারি আছে রেডিওথেরাপি পাওয়ার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের যেকোনো সরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি পেতে হলে রোগীকে কম বেশি তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়।

রোগীরা অপেক্ষমাণ সারিতে বসে থাকতে পারে কিন্তু শরীরে বাসা বেঁধে থাকা ক্যান্সার তো আর বসে থাকে না। নিরাময়যোগ্য ক্যান্সার ততদিনে হয়ে যায় অনিরাময়যোগ্য, বাড়তে থাকে চিকিৎসা ব্যয়। 

সুতরাং, বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার দুইটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ হলো, চিকিৎসা ব্যয় এবং চিকিৎসা প্রাপ্তিতে অপেক্ষমাণ সারি। কীভাবে এই দুই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা বছর জুড়ে হয়ে থাকে। তবে একটি সম্ভাব্য সমাধান কখনোই পৃষ্ঠতলে আসে না—তা হলো ক্যান্সার সেবায় দাতব্য প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসার কথা। 

ক্যান্সার চিকিৎসার সমাধান কখনোই সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব না। যুগে যুগে অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে এই অরাজক ব্যাধিকে বধ করার জন্য। বিশ্বের দুটি হাসপাতালের মধ্যে মূলত সেরা ক্যান্সার হাসপাতাল হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। একটি এমডি অ্যান্ডারসন ক্যান্সার সেন্টার (MD Anderson Cancer Center) এবং অপরটি মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার (Memorial Sloan Kettering Cancer Center)।

যুক্তরাষ্ট্রের এই দুটি হাসপাতাল দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে এখনো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় আরেকটি বড় নাম যুক্তরাজ্যের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতাল (The Royal Marsden Hospital)। এই হাসপাতাল ব্রিটিশ রাজপরিবারের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যান্সার হাসপাতালটির নাম টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল (Tata Memorial Hospital)। এই হাসপাতালও একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে বর্তমানে অলাভজনক সরকারি-বেসরকারি দাতব্য অংশীদারিত্বের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। 

আমাদের এই ভূখণ্ডেও ক্যান্সার চিকিৎসা শুরু হয়েছিল এরকমই এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। রণদাপ্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী হাসপাতালে ১৯৫৩ সালে দেশের প্রথম রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপিত হয়। সেই সময় ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল দুইটি—সার্জারি এবং রেডিওথেরাপি। মুক্তিযুদ্ধে রণদপ্রসাদ, তার সন্তান ও হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা নিহত হলে কুমুদিনী হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা সেবা মুখ থুবড়ে পরে।

রণদাপ্রসাদের পরে আর কোনো সমাজসেবীকে বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসায় তেমনভাবে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। দুই একজন শুরু করলেও পরবর্তীতে সেগুলো পুরোদস্তুর কর্পোরেট হাসপাতালেই পরিণত হয়।

আমাদের এই ভূখণ্ডেও ক্যান্সার চিকিৎসা শুরু হয়েছিল এরকমই এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। রণদাপ্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী হাসপাতালে ১৯৫৩ সালে দেশের প্রথম রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপিত হয়...

এক সাংবাদিক বন্ধু মারফত জানতে পারলাম, সম্প্রতি এক ব্যবসায়িক গ্রুপ একটি টিভি চ্যানেলের কার্যক্রম শুরু করেছে, যেখানে এককালীন সম্পদ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। কর্মচারীদের বেতন ও চলতি খরচের বাইরে শুধুমাত্র যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, যানবাহন ক্রয়েই এই ব্যয় করেছে গ্রুপটি। এই টাকা দিয়ে অনায়াসে ১০টি উন্নতমানের রেডিওথেরাপি মেশিন কেনা সম্ভব। মিডিয়ার পাশাপাশি অলাভজনক ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সেই ব্যবসায়িক গ্রুপটির প্রয়োজন শুধুমাত্র সদিচ্ছা।

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীদের জীবন রক্ষাকারী রেডিওথেরাপি মেশিন আছে ৪০টির মতো। রোগী অনুসারে আমাদের চাহিদা প্রায় ২৫০টি। এমনকি ঢাকার বাইরে সবগুলো বিভাগীয় শহরেও নেই রেডিওথেরাপি মেশিন। ফলে রোগীদের অপেক্ষার সারি হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।

বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসার এই অচলাবস্থা দূর করতে হলে শুধু সরকারের আশায় বসে না থেকে জনা পঁচিশেক রণদাপ্রসাদকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে এমডি অ্যান্ডারসন, স্লোয়ান ক্যাটারিং, রয়্যাল মার্সডেন কিংবা টাটা মেমোরিয়ালের মতো অলাভজনক ক্যান্সার হাসপাতাল। কমে আসবে চিকিৎসার বিশাল খরচ, থাকবে না চিকিৎসা প্রাপ্তিতে কোনো অপেক্ষমাণ সারি।

ডা. নাজিরুম মুবিন ।। চিকিৎসক, ক্যান্সার বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল