সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় যারা জিপিএ-৫ পেয়েছেন বা পাননি তাদের এবং তাদের অভিভাবকদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও অভিনন্দন দিয়ে এ লেখা শুরু করি। জিপিএ-৫ অর্জন অবশ্যই আনন্দের, তবে তা না পাওয়াও অগৌরবের নয়। এ লেখায় ক্ষুদ্র পরিসরে সে বিষয়টি তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছি।

শুরুতেই একটা উদাহরণ দেই। পৃথিবীর ধনী রাষ্ট্রপ্রধানদের অন্যতম আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার নিট সম্পদের পরিমাণ তিন বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ১০০০ মিলিয়নে হয় ১ বিলিয়ন; আর ১০ লাখে ১ মিলিয়ন। বুঝুন এবার কতটা ধনী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প!

এমন এক ডজনেরও বেশি ট্রাম্পকে এক সাথে করলে যত বড় ধনী কল্পনা করা যায় তারও চেয়ে বেশি ধনী চীনের নাগরিক জ্যাক মা, যিনি বর্তমানে চীনের সেরা ধনী। ট্রাম্প সাহেব কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক সম্পদই পেয়েছেন। অন্যদিকে, জ্যাক মা কিছুই পাননি, সবই তার নিজের পরিশ্রমে অর্জন করা। চীনের অতি সাধারণ এক পরিবারে তার জন্ম। ব্যবসায় নামার আগে আর দশজনের মতো চাকরির চেষ্টাও করেছেন জ্যাক মা।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি দিয়েছেন এ তথ্য। একবার তিনিসহ মোট ২৪ জন কেএফসি'র চাকরিতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ২৩ জনের চাকরি হয়; যার হয়নি তিনি জ্যাক মা নিজেই। এভাবে একে একে ৩০টি চাকরির ইন্টারভিউতে অকৃতকার্য হয়েছিলেন তিনি। চাকরিদাতারা কেন যেন তাকে চাকরি প্রদানের উপযুক্তই বিবেচনা করতে পারছিলেন না।

তাছাড়া, বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। পরপর দশবার হার্ভাডে ভর্তি আবেদন করেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন জ্যাক। এত ব্যর্থতার পরও ভেঙে পড়েননি জ্যাক মা, বরং নতুন উদ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। জীবন সংগ্রামে বারবার হোঁচট খেয়েও শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়েছেন। নাছোড়বান্দা তিনি; ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা পেতে রাতদিন চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তীতে একসময় কেবল সফলতা অর্জন নয়, একেবারে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হন জ্যাক মা।

জানেন তো, চীনা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ‘আলিবাবা’র প্রতিষ্ঠাতা এই এককালের ব্যর্থ-বেকার জ্যাক! বর্তমানে তার নিট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার।

এবার শুনুন আমার অতিপরিচিত এক বাংলাদেশির গল্প। তিনি আমার কয়েক বছরের সিনিয়র। পড়েছি একই স্কুল-কলেজে। বহু বছর আগে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন সরকারি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। ভালো ছাত্রদের একজন তিনি। পরীক্ষার সময় ভুলত্রুটি এড়াতে জ্যামিতি বক্সের কভারে কিছু গণিতের সূত্র লিখে এনেছিলেন। কিন্তু, বিধিবাম! ধরা পড়লেন এক কড়া টিচারের হাতে। নকলের দায়ে অভিযুক্ত হলেন তিনি। তখনকার দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় রাজনীতির এতটা প্রভাব ছিল না। শিক্ষকরা রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা না করেই চাইলে যে কোনো ছাত্রকে বহিষ্কার করার সাহস রাখতেন। আমার সেই অতিপরিচিত বড় ভাইও নকলের অভিযোগে বহিষ্কার হলেন এক বছরের জন্য। এমন দুর্ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্রদের জীবনকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। অথচ, তিনি দমে যাননি মোটেও। এ ঘটনায় যারপরনাই অনুতপ্ত হলেও আবারও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।

জীবনের ওই ভুল থেকে তিনি শিখেছেন অনেক কিছু। তখনকার দিনে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড পরিবর্তন করে বন্ধুপ্রতিম ওই বড় ভাই অনেক দূরের এক শিক্ষাবোর্ডের অধীনে দুবছর পর উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে খুবই ভালো ফলাফল করলেন। পরবর্তীতে, লেখাপড়ায় আরও বেশি মনোযোগী হয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হবার গৌরবও অর্জন করেছিলেন। পড়ালেখা শেষে দেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতাও করেছেন। এ গুণীজনের বিস্তারিত পরিচয় বলব না। শুধু এটুকু বলি, তিনি উন্নত দেশগুলোর একটিতে কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করছেন বর্তমানে। আমার সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।

এইচএসসি পরীক্ষায় বহিষ্কার হয়ে অপমানে-লজ্জায় আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটাতে পারতেন তিনি। অথচ, জীবনের এ ভুলটিকে উন্নতির সোপান হিসেবে ব্যবহার করে বর্তমানে তিনি আমার চেনাজানা অতি সফলদের একজনে পরিণত হয়েছেন।

হঠাৎ এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠলাম কেন? কারণ হলো, পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল না করে অনেক ছাত্র-ছাত্রী মুষড়ে পড়ে; ভাবে, ভালো জিপিএ- ৫ না পাওয়ায় জীবনটা বুঝি অর্থহীন হয়ে গেল। অভিভাবকদের অনেকেও অপেক্ষাকৃত খারাপ রেজাল্ট করা সন্তান বা পোষ্যদের বকাবকি শুরু করেন ক্ষেত্রবিশেষে। এতে মানসিক চাপে পড়ে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা দিশেহারা হয়ে আত্মহত্যার মতো দুর্ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলতে পারে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।

ফল একবার তেমন ভালো হয়নি তো কি হয়েছে? যোগ্যতা প্রমাণের এটাই তো শেষ সুযোগ নয়। জীবনটা অনেক বড়ো। পরীক্ষায় ভালো ফল করা অবশ্যই ভালো। তারপরও আমাদের বুঝতে হবে, পরীক্ষায় ভালো গ্রেড পাওয়া না পাওয়ার সাথে অনেক সময়ই বাস্তবজীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া না পাওয়ার তেমন সম্পর্ক থাকে না।

কর্মক্ষেত্রে আমরা কী দেখি? কেউ কেউ সাধারণ বিএ পাশ করে বা না করেও জীবনে যতটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন অনেকে মাস্টার্স-পিএইচডি করেও তা পাননি। এমন দৃষ্টান্ত এক-দুটি নয়, অসংখ্য। জিপিএ-৫ বা, গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ারাই যে বাস্তব জীবনে সবচেয়ে সফল নায়ক তা কিন্তু নয়। জীবনের সফলতা কেবল জিপিএ'র ওপর নির্ভর করে না। বাস্তব জীবনে সফল হতে সবচেয়ে বেশি দরকার সুপরিকল্পনা, সময়ানুবর্তিতা আর অধ্যাবসায়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে ঠিক মতো কাজে লেগে পড়লে জীবনে ব্যর্থ হওয়াটাই বরং কঠিন।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল করলে দেশি বা আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রুত চাকরি মেলে— এটা হয়তো মিথ্যা নয়, কিন্তু চাকরিতে নিজের দক্ষতার প্রয়োগ ও উন্নয়ন ঘটিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সফলতা কেবল উচ্চ জিপিএধারীরাই অর্জন করেছেন পৃথিবীতে, এমন কোনো পরিসংখ্যান আছে বলেও শোনা যায়নি।

উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক ও যারা সৃজনশীল শিল্পে রয়েছেন তারা ছাঁচ ভেঙে নিজেদের সাফল্য রচনা করেন। অন্য ভাষায়, সেরা উদ্যোক্তারা উচ্চ জিপিএ অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পড়ালেখা তথাকথিত ভালো ছাত্রদের মতো নিয়ম বেঁধে নাও করতে পারেন; তারপরও তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা বা উদ্যোগ থেমে থাকে না। এমন ব্যক্তিদের ক্লাসিক উদাহরণ হিসেবে প্রায়শঃই স্টিভ জবস বা বিল গেটস এর নাম চলে আসে। স্টিভ জবস কেবল ২.৬৫ জিপিএ পেয়ে উচ্চ বিদ্যালয় সম্পন্ন করেছিলেন। আর বিল গেটস তো কলেজের পড়ালেখাই শেষ করেননি। এমন নজির আমাদের বাংলাদেশেও নেহাত কম নয়।

কোনো ভালো কাজের ফল হঠাৎ পাওয়া যায় না। জীবনে সফলতা অর্জনও একটি ধীর প্রক্রিয়া। সেখানে আলাদিনের চেরাগের মতো রাতারাতি কিছু পাবার আগ্রহ মরুভূমির মরীচিকা ছাড়া কিছু নয়। জিপিএ- ৫, গোল্ডেন জিপিএ, এসব সংশ্লিষ্ট ছাত্র-ছাত্রী, তাদের অভিভাবক বা আত্মীয়স্বজনের জন্য সাময়িক চমকের কারণ হতে পারে। তবে, এর দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্ব খুব বেশিকাল থাকে না।

স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছাত্রটাই কি বাস্তবের সবচেয়ে সফল মানুষ? অবশ্যই না। পাবলিক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল হয়নি বলে হতাশায় ভোগা আপনার সন্তান বা পোষ্যকে এ সত্যটি ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। তারা দ্রুত হতাশা কাটিয়ে উঠবেন। ফলে, ভবিষ্যতে আরও ভালো ফল করতে উৎসাহিত হবেন এসব সম্ভাবনায় তরুণ-তরুণীরা।

এম এল গনি ।। আরসিআইসি কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট ও কলামিস্ট