ছবি : সংগৃহীত

‘হয়তো কিছুই নাহি পাব, তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালবেসে যাব,’ ‘এই পথ যদি না শেষ হয় ’, ‘এই শুধু গানের দিন’, ‘আমি তার ছলনায় ভুলবো না ’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’... গানগুলো যেন তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল আমাদের কিশোর মনের প্রেম বা আগ্রহ হিসেবে। জাদুকরী এক আশ্চর্য কণ্ঠস্বর! সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেইতো আমাদের তিন প্রজন্ম সংগীত চিনেছিল। 

লতা মঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সখ্য সকলেরই জানা। আজ মনে হচ্ছে, এক সরস্বতী আর এক সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন! ঠিক যেন দুই বোনের মতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গায়ক না হলেও, শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে তার ছিল  বরাবরের আগ্রহ। বড়ে গুলাম আলি খানের ছাত্রী ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। কিন্তু আমরা দেখে আসছি যখন আধুনিক গান গাইতেন, তখন পাল্টে ফেলতেন গায়কী! এমনই ছিল তার দক্ষতা। 

তখন আমরা টগবগে যুবক, তার সেই মধুর গানগুলো শুনতাম আর এক আশ্চর্য গায়কীতে মুগ্ধ হতাম। তার কণ্ঠস্বর একেবারে জাদুকরি। আজ তিনি চলে গেলেন। দেহের অবসান তো আছেই। সে তো ঠেকানো যাবে না। কিন্তু তার গান রয়ে গেল। মানুষ তো শরীরে বেশি দিন বাঁচে না। আয়ুষ্কাল পর্যন্ত বাঁচে। তারপরে কেমন করে বাঁচে? 

দুই বাংলার কোটি কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রাণের শিল্পীর জন্য সাধারণ মানুষের মনতো কাঁদছেই। তাছাড়া রাজনৈতিক নেতা নেত্রী বা সেলিব্রেটিরাও ব্যথিত মনে দুঃখ প্রকাশ করছেন যে যার আঙ্গিকে। সন্ধ্যার প্রয়াণে ব্যথিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। 

প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ভাবতে পারিনি তিনি মারা যাবেন। গতকাল রাতে অস্ত্রোপচারের পর খবর এসেছিল, কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে তা বুঝতে পারিনি। উনিই শেষ সুরের ঝংকার, সুরের স্পন্দন, গানের ইন্দ্রধনু। তার গাওয়া কত গান মনে পড়ছে এখন।

বলা হয়ে থাকে বাংলা গানে স্বর্ণযুগের শিল্পীদের শেষ তারকা হয়ে প্রতিদিন আলো দিতেন, তিনিও নিভে গেলেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ৯০ বছর বয়সে। আধুনিক বাংলা গানের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়রা একে একে চলে গিয়েছেন আগেই। এবার নিভল সন্ধ্যাপ্রদীপও। 

বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ১৯৭০ সালে 'জয় জয়ন্তী' এবং 'নিশি পদ্মা' ছবিতে তার গানের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী প্লেব্যাক গায়ক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন। ২০১১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণও পেয়েছিলেন। অবশ্য এ অসুস্থতার মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা টেলিফোনে তার সম্মতির জন্য যোগাযোগ করলে তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। আমার ছাত্রাবস্থায় বহু বছর কেটেছিল ওই ঢাকুরিয়ায়। অবশ্য রাস্তা-ঘটে সাক্ষাৎ মেলেনি কোনোদিন এ দেবীর। শুধু বার কয়েক কোনো অনুষ্ঠানে দেখেছি দূর থেকে।  ছোট বয়স থেকেই তার গানের শিক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সংগীতের তালিম নিয়েছেন পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। এছাড়াও গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান এবং তার পুত্র মুনব্বর আলি খানকে। 

শাস্ত্রীয় সংগীতের দীর্ঘ শিক্ষার পর একসময় আসেন প্লেব্যাক গানে। ১৯৪৮ সালে 'অঞ্জন গড়' ছবিতে প্রথম প্লে ব্যাক করেন তিনি। তারপর 'সব্যসাচী', 'পহেলা আদমি', 'সাজা'সহ বহু ছবিতে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে শোনা যায় তার গলা। একটা সময় মুম্বাইয়ে থেকে রীতিমতো বলিউডে গান গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। যদিও কয়েক বছর পর ব্যক্তিগত কারণেই ফিরে আসেন কলকাতায়। 

হিসেবে করে দেখা যায়, মোট ১৭টি হিন্দি ছবিতে গান গিয়েছিলেন তিনি। বাংলা গানের সোনালী যুগের কথা উঠলে প্রথমেই যাদের সুরেলা কণ্ঠের কথা মনে পড়ে তাদের অন্যতম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শ্রোতাদের মনে যার কণ্ঠের ধ্বনি আজও একইরকম সতেজ ও সজীব। আর শুধু বাংলা গানই নয়, হিন্দি ছবির গানেও নিজের পায়ের তলার জমি শক্ত করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গেয়েছেন একের পর এক হিট গান। 

একইভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের বাজারেও প্লে ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। 'জয়জয়ন্তী', 'নিশিপদ্ম', সন্ধ্যা দীপের শিখা', 'সপ্তপদী'র মতো সিনেমায় তার গাওয়া গান এভার গ্রিন হয়েই থেকে গেছে। সেই সময়ের আরও এক বিখ্যাত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ডুয়েটে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্য গান। 

আমাদের কাছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সব কৃত্যের সাথে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো একজন সংগীত শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও পরোক্ষভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে তোলা, সবেতেই অংশ নেন তিনি। এছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করা বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেল থেকে মুক্তি উপলক্ষে ‘বঙ্গবন্ধু তুমি এলে’র মতো গানও গেয়েছেন সন্ধ্যা। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল তাতেও বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি।  

স্মরণে, মননে, স্মৃতিতে। তার গানে। বারবার তার গান আরও বহুকাল ধরে তিতির পাখির মতো আমাদের চার দিকে নেচে বেড়াবে। এ রকম শিল্পীর তো আসলে মৃত্যু হয় না। তাদের মরণ নেই। তারা জীবিত থাকেন চিরকাল। বারবার তাদের সরণ হয়। ওই যাকে বলে, মানুষের মনের মধ্যে বেঁচে থাকা। তার মতো বেঁচে থাকা কি আর আছে?

নুরুল ইসলাম বাবুল।। শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক