একটা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। ২০০৬ সালে অনলাইনে বিপ্লব হয়ে এসেছিল কমিউনিটি বাংলা ব্লগ। সেখানে আমি কবিতা চর্চার বাসনায় নিবন্ধিত হয়েছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল কবি হবো। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেল দ্রুতই। দেখলাম সেখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চরম বিতর্কিত সব পোস্ট হচ্ছে। মিথ্যায় ভরপুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি শিশু। তারপরও আমার মননে, আমার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের যে অবয়ব, তাতে বারবার আঘাত হেনেছে এইসব পোস্ট। সেই স্মৃতিরক্ষার লড়াইয়ে নামলাম। মুক্তিযুদ্ধের উপর যাবতীয় বই, নথিপত্র নিয়ে হামলে পড়লাম সেই লড়াইয়ে। আমার কবি হওয়া হল না, কিন্তু নতুন করে বিশাল এক ক্যানভাসে মুক্তিযুদ্ধ স্বরূপে উদ্ভাসিত হল আমার সামনে। আবারও আমি গর্বিত হলাম নিজের শিকড় সন্ধানে। অতীত খুঁড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি- শ্লোগানে এখনও নিমগ্ন আমি।

উঠতি প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ বরাবরই দুটো তারিখের নাম। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এই হল মুক্তিযুদ্ধ। সিনেমা স্টাইলে গোলাগুলি, দেশ স্বাধীন। মাঝে আর কিছু নেই। এই অবস্থানকে আমি তাদের অনীহা বলবো না। বরং এই অবস্থার জন্য আমি বড় দাগে দায়ী করবো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে। সরকারি তরফে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস মূর্খ হয়ে বেরিয়েছে। পরীক্ষায় পাশ করার জন্য দরকার ছিল দুটো তারিখ জানা, সেটাই তারা জেনেছে। এর বেশি নয়। তাও মাঝে মাঝে গুবলেট করে ফেলে কোন তারিখটা কেন! আর এই সুযোগটাই নিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। তারা ইচ্ছা মতো মনগড়া ইতিহাস শিখিয়েছে তাদের। সবই তাদের প্রয়োজনে। সেইখানে সঠিক ইতিহাস জানানোটা মুখ্য ছিল না, প্রয়োজনীয়তাই ছিল মুখ্য। ফলে শুরুতেই তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা তা অনুধাবন করার অবস্থায় তারা নেই, কারণ ভিত্তিটাই তো গড়ে ওঠেনি। এভাবেই আমাদের গর্বের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ৩০ লাখ শহীদ ও লাখো বীরাঙ্গনা উপহাস হয়ে ধরা দিয়েছে তাদের কাছে!

উঠতি প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ বরাবরই দুটো তারিখের নাম। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এই হল মুক্তিযুদ্ধ। সিনেমা স্টাইলে গোলাগুলি, দেশ স্বাধীন। মাঝে আর কিছু নেই… এই অবস্থার জন্য আমি বড় দাগে দায়ী করবো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে।

প্রশ্ন হল, তারা কি তাহলে আগ্রহী না? নিজের পূর্বপুরুষের শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস সম্পর্কে তারা কি আসলেই উদাসীন? আমি বলবো- না, তারা উদাসীন নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক সেই রূপটা তাদের কাছে উপস্থাপিত হয়নি সেই ভাবে। না সরকারের তরফে, না পারিবারিক তরফে। মুক্তিযুদ্ধের মূল ব্যাপারগুলো তাদের খোলাসা করে না জানানোয় আজও তারা শত্রু মিত্র চিনতে ভুল করে। স্বাধীনতা বিরোধীদের পালে অনায়াসে বাতাস দিয়ে যায়। কিন্তু তার থেকে উত্তরণ কি সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। না হলে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ হতো না। যার কৃতিত্ব বাংলা ব্লগারদেরকেই দিতে হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে কয়েকটা মাস বাংলা ব্লগ যুদ্ধাবস্থায় ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দিনরাত খেয়ে না খেয়ে ব্লগিং করে গিয়েছি আমরা। সেই সময়টায় স্বাধীনতা বিরোধী ব্লগারদের প্রতিটি মিথ্যাচার দলিল সহকারে জবাব দেয়া হয়েছে। তথ্য প্রমাণ অডিও লিংক, ভিডিও লিংক বাদ ছিল না কিছুই, পুরাই মাল্টিমিডিয়ার সর্বোচ্চ ব্যবহার যাকে বলে!

সেই সময়কালেই এই ব্লগিংয়ের সুফল পাওয়া শুরু হয়। ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইন চর্চায় অভ্যস্ত তারুণ্য বুঝতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ কি, কারা এর নেতৃত্ব দিয়েছিল, কারা আমাদের সাহায্য করেছে, কারা ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাসত্ব করেছে। চিনিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষদের, ধরিয়ে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের, জোর করে তুলে নিয়ে সেনা ক্যাম্পে দিয়ে এসেছে মেয়েদের, লুটপাট করে-আগুন দিয়ে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে হিন্দুদের। এক কোটি মানুষ কেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত গেল? কারা এদেশে বসে রাজাকার আলবদর গঠন করল? বিজয়ের ঠিক আগে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করল- প্রমাণ সহকারে জানল অনলাইন প্রজন্ম। তারই ধারাবাহিকতায় যখন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তির ঘোষণা এলো না, তারা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামলো। দাবী আদায় করে ছাড়ল। ফাঁসিতে ঝোলাতে বাধ্য করল শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাসেম আলী ও আব্দুল কাদের মোল্লাকে।

১৯৭১ সালের ক্যালেন্ডার আর ২০২১ সালের ক্যালেন্ডার হুবহু এক! দিন তারিখ হুবহু, কোনো তারতম্য নেই।

এটাকে বলা চলে সময়ের দাবি। সেই তারুণ্য বুড়িয়ে যায়নি, ঝিমিয়ে গেলেও ভুলে যায়নি তার ইতিহাস। তাই আমি আশাহত নই। প্রশ্ন যদি ওঠে আগ্রহ ও তার পরিমাপের, তাহলে বলব সেজন্য একটা বড় সহায় হয়ে এসেছে ২০২১ সাল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালের ক্যালেন্ডার আর ২০২১ সালের ক্যালেন্ডার হুবহু এক! দিন তারিখ হুবহু, কোনো তারতম্য নেই। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে এই সমিলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা। প্রতিটি দিনকে হাইলাইট করে তরুণ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন। যাতে তারা জানতে পারে রক্তক্ষয়ী সাড়ে নয়মাস বলতে আসলে কি বোঝায়! জন্মযুদ্ধ মানে আসলে কি! কতটা ত্যাগের বিনিময়ে উড়ছে ওই লাল সবুজ পতাকা, কত রক্তস্নাত হয়ে পেয়েছি আমাদের এই মানচিত্র!

আগ্রহ না থাকলে তৈরি করা যায়। আমি যদি জানি আমার পূর্বপুরুষ বীরের দল, সামান্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর কয়েকটা বুলেট সম্বল করে জীবন বাজি রেখে ছিনিয়ে এনেছে এই বাংলার জয়- আমি কেন আগ্রহী হবো না!! তারাও হবে। পূর্বপুরুষের সেই সম্মান রাখতেই তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের বিনির্মাণে জীবন বাজি রাখবে তারাও, আমাদের নতুন প্রজন্ম।

পূর্বসূরিরা স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই এই দেশ পেয়েছি আমরা। উত্তরসূরিদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে তাই বাধা কই!

অমি রহমান পিয়াল ।। সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট

omipial@gmail.com