আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার’ শিরোনামে একটি রূপরেখা তৈরি করছে বিএনপি। আগামীতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যারা শরিক হবেন তাদের নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হতে পারলে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হবে। এ জাতীয় সরকারের মাধ্যমে রূপরেখায় উল্লেখ করা বিষয়গুলো সংস্কার করবে বিএনপি। আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা সমাবেশে বা তার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রূপরেখার ঘোষণা আসতে পারে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ‘রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার’ রূপরেখায় যেসব বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে সেগুলো হলো- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, সংবিধান সংস্কারে কমিশন গঠন, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার প্রচলন, প্রশাসনিক সংস্কারে কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের সংশোধন, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন আইনের সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক হত্যার বিচারের জন্য মিডিয়া কমিশন গঠন, জাতীয় সমঝোতা কমিশন গঠন, দুর্নীতি বন্ধে ন্যায়পাল নিয়োগ, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা তৈরি, বেকার ভাতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন। এমন মোট ২৭টি বিষয় ওই রূপরেখায় স্থান পেয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে আমাদের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে। সেখানে জনগণের চাহিদা বিবেচনায় সামনের দিনে আমরা যুগপৎ আন্দোলনের পরিকল্পনা করছি। যা সময় মতো প্রকাশ করা হবে।

‘যুগপৎ আন্দোলনের জন্য আমরা অনেকের সঙ্গে সংলাপ করেছি। তাদের পক্ষ থেকে যেসব দাবি-দাওয়া এসেছে, সেগুলো সমন্বয় করে আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে’— উল্লেখ করেন মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, প্রশাসনের সংস্কার এবং সংবিধানের বিতর্কিত ধারাগুলোর সংশোধনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রূপরেখায় সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকবে আমাদের।

বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রূপরেখা ঘোষণা করা হবে কি না— জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। দেখা যাক কী হয়?’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপির অনেক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক আছে। আবার ক্ষমতায় গেলে অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? তাই যুগপৎ আন্দোলনে আগ্রহী বিরোধী দলগুলো চাইছে ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী করবে তা যেন আগেই জনগণের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়। বিএনপিও মনে করছে, ক্ষমতাসীন দলকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হলে সবাইকে নিয়ে আন্দোলনে নামা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। যে কারণে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করা দলগুলো থেকে আসা দাবিগুলো এবং নিজস্ব পরিকল্পনাগুলো নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপি যদি এবার ক্ষমতার পরিবর্তন আনতে না পারে তাহলে আগামীতে দলের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে এখন যারা আছেন তাদের অনেকেই আগামীতে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পারবেন না। অনেক নেতার বয়স হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। তিনি কতদিন আমাদের মাঝে থাকবেন, তারও ঠিক নেই। তাই সব বিরোধী দলকে নিয়ে একটি চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা আমাদের এখন মূল লক্ষ্য। যে কারণে অন্যান্য বিরোধী দল ও জনগণ রাষ্ট্রের যেসব সংস্কার বা সংশোধন আনার পক্ষে, সেগুলো আমরা ‘রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার’ রূপরেখায় তুলে ধরব। যাতে ভোট দেওয়ার একটা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। মানুষ বিএনপির অতীত কর্মকাণ্ড ভুলে ভবিষ্যতে কী করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সেটা মাথায় রেখে যেন ভোট দেয়।  

‘রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার’ রূপরেখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপি আগামীতে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সেজন্য রাষ্ট্রের কী কী পরিবর্তন আনা হবে, তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হবে রূপরেখায়। সে কারণে সবার সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ‘জাতীয় সমঝোতা কমিশন’ গঠন করা হবে। বর্তমান বিতর্কিত নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সংবিধান সংশোধন করে স্থায়ীভাবে ‘নির্বাচনকালীন দল-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। দলীয় বিবেচনার বাইরে গিয়ে সংবিধানের ৯৫ (গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা বিবেচনায় বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ রাখার প্রতিশ্রুতি থাকবে। হুটহাট ভিন্ন দলের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাহী আদেশ বলে অপসারণ করা হবে না— বিষয়টি রূপরেখায় নিয়ে আসা হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, যেকোনো সময় এ রূপরেখার ঘোষণা আসতে পারে। তবে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ পুরো রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি অর্গানকে তারা ধ্বংস করেছে। একটি রাষ্ট্র যেসব অর্গানের ওপর ভিত্তি করে চলে, সেগুলোকে তারা মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমাদের এ ‘রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার’ রূপরেখা। শিগগিরই এটি প্রকাশ করা হবে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ এ দেশকে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছে, নর্দমা বানিয়ে ফেলেছে। এটা পরিষ্কার করতে হবে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে। প্রশাসন ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে। এটাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। সত্যিকার অর্থে একটি আধুনিক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ চলছে।

এএইচআর/জেডএস