সরকারের পদত্যাগ, একাদশ সংসদ বিলুপ্ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে সরকারবিরোধী দলগুলো। ২৪ ডিসেম্বর ৯ বিভাগীয় শহরে এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের মাধ্যমে আন্দোলনের এ ধারা শুরু হয়েছে।   

‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’র এই আন্দোলনে ধীরে ধীরে রাজপথে নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তির জানান দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও আন্দোলন শুরুর এক মাস যেতে না যেতেই বেকায়দায় পড়েছে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীরা। এই আন্দোলনে ঘন ঘন যে কর্মসূচি আসছে আর্থিক সংকটের কারণে তার সাথে তাল মেলাতে পারছে না ছোট দল ও সংগঠনগুলো। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে আশানুরূপ জনসমাগমও ঘটছে না।

এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের উপহাসেরও শিকার হতে হচ্ছে তাদের।  

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনসঙ্গী বিলুপ্ত হওয়া ২০ দলীয় জোটের শরিকরা বলছেন, জোটে থাকার সময়ে বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করতো। আমরা জোটের নেতারা সেখানে মঞ্চে গিয়ে বসতাম। বক্তব্য দিয়ে চলে আসতাম। তখন প্রোগ্রামে নেতাকর্মীদের সমাগম ঘটানোর কোনো চাপ থাকতো না আমাদের। কিন্তু এখন যুগপৎ আন্দোলন করতে গিয়ে আলাদা করে আমাদের প্রোগ্রামের আয়োজন করতে হচ্ছে। সেখানে নিজেদের খরচে নেতাকর্মীদের নিয়ে আসতে হচ্ছে। আবার বিএনপির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহে প্রোগ্রাম করতে হচ্ছে। যার ফলে ছোট-ছোট জোটগুলোকে বেশ আর্থিক সংকটে পড়তে হচ্ছে। 

তারা আরও বলেন, সভা-সমাবেশগুলোর লোক সমাগমে এর প্রভাব পড়ছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের উপহাসের শিকার হতে হয়েছে আমাদের। আবার বিএনপির পক্ষ থেকে রাজপথে শক্তি বাড়াতেও বারবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাই এখন আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে, কিভাবে নিজ-নিজ দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়ে রাজপথে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়।

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দলীয় জোটের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের মাঝের একটি প্রোগ্রামে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি হয়তো কিছুটা কম ছিল। কিন্তু পরের প্রোগ্রামগুলোতে সবাই নিজেদের সর্বোচ্চ জমায়েত করেছে। আশা করছি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই আন্দোলনে ধীরে ধীরে রাজপথে আমাদের শক্তি আরও বাড়বে।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে ১২ দলীয় জোটের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ১২ দলীয় জোটের ৬টি দলই অন্তঃসারশূন্য। যাদের কোনো সাংগঠনিক শক্তিও নেই। আবার আর্থিকভাবেও তারা খুবই দুর্বল। বাকি আবার যে ৬টি দল আছে, তাদেরও আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো তাও না। ফলে, নামে ১২ দলীয় জোট হলেও মূলত ৬ দলকে সবকিছু করতে হচ্ছে। যার কারণে সীমিত অর্থ থেকে খরচ বাড়ার কারণে আর্থিক সংকট দিন দিন বাড়ছে।   

তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে প্রায় প্রতি সপ্তাহে যুগপৎ আন্দোলনের কোনো না কোনো কর্মসূচি থাকছে। যার কারণে আমাদের আলাদা করে সেই প্রোগ্রামগুলোও করতে হচ্ছে। বর্তমান বাজারে একজন নেতাকর্মীকে প্রোগ্রামে আসা-যাওয়ার ভাড়া হিসেবেও ন্যূনতম ৫শ টাকা দিতে হয়। ফলে, ইচ্ছে থাকলেও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকার প্রোগ্রামে আনতে পারি না।   

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের আরেক জোটসঙ্গী ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’। ভেঙে যাওয়া ১১টি দলের ভগ্নাংশ নিয়ে গঠিত এই জোটের শরিকরাও বিলুপ্ত হওয়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ছিল। এই জোটের নেতারা বলছেন, ২০ দলীয় জোটের প্রোগ্রামে বিএনপির পরে সাধারণত জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের সমাগম বেশি হতো। শুধু তাই নয়, আর্থিকভাবেও বিএনপির পরে জামায়াত শক্তিশালী ছিল। সেই সময় ২০ দলীয় জোটের অনেক দলকে জামায়াত আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতো।   

যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের পর ১১ জানুয়ারি সারা দেশে গণ অবস্থান কর্মসূচি, ১৬ জানুয়ারি সমাবেশ ও মিছিল, ২৫ জানুয়ারি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।  এছাড়া আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে। 

এ জোটের নেতারা আরও বলছেন, মাঠ পর্যায়ে আমাদের তেমন কোনও নেতাকর্মীও নেই। যাদের কাছ থেকে মাসিক কিংবা এককালীন চাঁদা আনব। যার কারণে এক ব্যক্তির অর্থ দিয়ে পুরো সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। ফলে, বিলুপ্ত হওয়া ২০ দলীয় জোটে দুই-একটি দল ছাড়া সবার আর্থিক সংকট প্রকট। আর এই সংকটের কারণে প্রোগ্রামগুলোতে জনবলেরও উপস্থিতিও বাড়ানো যাচ্ছে না।

এই জোটের শরিক জাগপার একাংশের সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আমাদের প্রোগ্রামগুলো ভালো করার চেষ্টা করছি। আগামীতে আরও ভালো করার চেষ্টা করব। জনবল বাড়ানোরও চেষ্টা করছি।

এক প্রশ্নের জবাবে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আমাদের নিজেদের আর্থিক অবস্থান অনুযায়ী চলতে হচ্ছে।   

ডানপন্থী ও বামপন্থী ৭টি দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের বড় শরিক এই জোট। অন্য জোটগুলোর থেকে তুলনামূলক ভালো হলেও আর্থিকভাবে এই জোটের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। অন্যদিকে এই জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন নুরুল হক নুরের নেতৃত্বধীন গণঅধিকার পরিষদ। যার ফলে, এই জোটের প্রোগ্রামগুলোতে আশানুরূপ জনসমাগম হচ্ছে না। 

জোটের নেতারা বলছেন, গণতন্ত্র মঞ্চ গঠন হওয়ার পর থেকে জনগণের যে সমর্থন পেয়েছে, সেই পরিমাণে অংশগ্রহণ হচ্ছে না। জোটের দলগুলোর লজিস্টিক সাপোর্টেরও অভাব আছে। তাছাড়া ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আসা দলগুলো একসঙ্গে হলেও এখন নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া খুব বেশি দূর এগোয়নি। এটা এখনও অনেকটা জোটের চাইতে ইস্যু ভিত্তিক মঞ্চ হয়ে আছে। অন্যদিকে নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং একে অন্যের দিকে চেয়ে থাকার কারণে প্রোগ্রামগুলোতে জনসমাগম কম হচ্ছে। এটা নিয়ে জোটের মধ্যেও আলোচনা হয়েছে।   

এই জোটের সমন্বয়ক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমাদের প্রোগ্রামগুলো ভালো হচ্ছে। আশা করি সামনে আরও ভালো হবে।

জোটের আরেক শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, জোটের প্রোগ্রামের দিন অনেক সময় দেখা যায়, দলগুলোর নিজস্ব প্রোগ্রামও থাকে। যার কারণে কিছু প্রোগ্রামে জনসমাগম কম হতে পারে। এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা করি, ধাপে ধাপে সেটা কেটে যাবে।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে জোটের এক শীর্ষ নেতা বলেন, আসলে গণতন্ত্র মঞ্চের এখনও অনেক লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব আছে। যেমন মিরপুর থেকে ১০০ লোক আনতে কম করে হলেও ১০ হাজার টাকা বাস ভাড়া দিতে হবে আমাকে। কিন্তু সেই অর্থ তো আমাদের নেই। তাছাড়া ভিন্ন রাজনৈতিক আর্দশ থেকে আসার কারণে জোটের মধ্যকার কম্বিনেশনও খুব একটা জমে ওঠেনি। 

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের জোটসঙ্গীদের মধ্যে আর্থিক ও সাংগঠনিকভাবে সব চাইতে খারাপ অবস্থা বামপন্থী ৪ দলের সমন্বয়ে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের’। ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে’ যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১৬ জানুয়ারি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে এই জোট। তাদের কর্মসূচিতে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন।

এই জোটের সমন্বয়ক বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (মার্কবাদী-লেলিনবাদী) সাধারণ সম্পাদক কমরেড হারুন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের গ্রাম অঞ্চলের সংগঠন। কিন্তু এই গরিব লোকগুলোর ঢাকায় আসতে কত টাকা ভাড়া লাগে সেটা তো জানেন। তাই আমরা ৫০ জন, ১০০ জন নিয়ে রাস্তায় নামি এটাই আমাদের কাছে বড় বিষয়।

তিনি আরও বলেন, রাস্তায় ৫০ জন নামল নাকি আরও বেশি লোক নামল, সেটা আমাদের কাছে বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে আমাদের প্রতিবাদের বিষয় জনগণের পক্ষে না বিপক্ষে সেটাই। সেটা যদি জনগণের পক্ষে হয়, এটাই আমাদের বড় পাওয়া। এই টাকার রাজনীতির যুগে কিছু লোক যে এখনও মার্কসবাদী রাজনীতি করছে এটাই তো অনেক বড় পাওয়া।     

১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির আর্থিক অবস্থাও আগের মতো নেই। যার কারণে তারাও আন্দোলনের জোট সঙ্গীদের আর্থিকভাবে কোনো ধরনের সাহায্য করতে পারছে না। 

বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ১৪-১৫ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে অধিকাংশ নেতার ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থার মধ্যে এখন প্রায় প্রত্যেক দিন আমাদের কোনো না কোনো প্রোগ্রাম করতে হচ্ছে। ফলে, এখন আর্থিকভাবে বিএনপিকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কাউকে সাহায্য করার মতো অবস্থা এই মুহূর্তে বিএনপির নেই।

এএইচআর/এনএফ