ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এখন আর এ পৃথিবীর বাসিন্দা নন। তিনি অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছেন। যাপিত জীবন শেষে ১৬ মার্চ মারা যান। মানুষ এ পৃথিবীতে একা আসেন। একা চলে যান। অলঙ্ঘনীয় যে বিধান, তাকে উপেক্ষা করার সাধ্য কারও নেই। পৃথিবীর যত বড় শক্তিমান আর খ্যাতিমানই হোন না কেন, মৃত্যুভয় তাকে পায়নি— সেটা স্বাভাবিক নয়। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ আর মায়াবী ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষও নেই। মৃত্যুকে মানুষ ভয় করেছে সবসময়। একে জয় করার চেষ্টাও মানুষ কম করেনি। আজ অবধি করছে। কিন্তু মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শের কাছে সব চেষ্টাই থেমে গেছে।

মানুষের কর্ম মূল্যায়িত হয় দু’ভাবে। জীবদ্দশায়, আর মৃত্যুর পর। জীবদ্দশায় মানুষের দোষ-ত্রুটি শোধরানোর উপায় থাকে। মৃত্যুর পর সে সুযোগ আর থাকে না।

সন্দেহ নেই যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলাদেশের আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এক বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষে তার জীবনাবসান ঘটেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা দীর্ঘকাল আলোচনায় থাকবেন, এ দেশের ইতিহাসে যারা ঠাঁই করে নিয়েছেন স্থায়ীভাবে, মওদুদ আহমদ তাদেরই একজন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অধ্যায়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাকে নিয়ে তাই আলোচনাও হয়েছে বিস্তর।

ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতায় তিনি কখনও নন্দিত আবার কখনও সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তি মওদুদ আহমদ সবসময়ই থেকেছেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কাতারে। এখানেই তিনি অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন এবং কারাবরণও করেন। ঢাকা কলেজে তিনি ছাত্র সংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন ফরমান উল্লাহ খানের খেলাফতে রব্বানী পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে তরুণ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এর সমর্থনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। পাকিস্তানি শাসকদের দায়ের করা ১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকারী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে বৈঠক হয় সেখানেও মওদুদ আহমদ সহযোগী ছিলেন।

মুজিবনগর সরকারে তিনি প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই পদ তার জন্য উপযুক্ত ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কথা তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। স্বাধীনতার পর সে সময়ের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তার সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িত নেতৃস্থানীয়রা বেশিরভাগই পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে মূল্যায়িত হন। কিন্তু মওদুদ আহমদ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি সেভাবে মূল্যায়িত হননি। যে কারণে তিনি মনোযোগী হন আইন পেশায়। সে সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মওদুদ আহমদকে নতুন রূপে দেখা যায়। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর তিনি তার সঙ্গে নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অবস্থান ও জীবন সত্যিই ছিল বর্ণাঢ্য। আবার বৈপরীত্য ছিল প্রচুর। ফলে তাকে নিয়ে সবসময়ই আলোচনা হয়েছে।

১৯৭৬-২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রেই অবস্থান করেছেন সরকারে কিংবা প্রধান বিরোধী দলের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে। দেশের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তিনি নিজেকে এমনভাবে জড়ান যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে একজন অপরিহার্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস তাকে বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়।

মওদুদ আহমদ শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ ছিলেন এমন নয়। আইনজীবী হিসেবেও ছিলেন নেতৃস্থানীয়। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের আঙিনায় তার দীর্ঘ সরব উপস্থিতি বহুকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আইনজীবী হিসেবে তার যুক্তিপূর্ণ ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য অনুকরণীয় ও শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। মওদুদ আহমদ কথা বলতেন যুক্তি দিয়ে। তিনি তার প্রতিপক্ষকেও কোনোদিন আঘাত করে কিংবা মন্দ বাক্য ব্যবহার করে কথা বলেননি।

আইনজীবী ও রাজনৈতিক জীবনের বাইরে তার একটা লেখক সত্তা ছিল। সেখানে তিনি ছিলেন একেবারে নির্মোহ। মওদুদ আহমদ ডজনখানেক বই লিখেছেন। ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’, ‘এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ এবং ‘এরা অফ শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি’- এসব শিরোনামে লেখা তার তিনটি বই ব্যাপক আলোচিত। ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ১৯৯১ থেকে ২০০৬’, ‘কারাগারে কেমন ছিলাম ২০০৭-২০০৮’ - এই শিরোনামের দুটি বইও ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল।

বাংলাদেশের রাজনীতি, শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি ও এর দুর্বলতা, গণতন্ত্র, তার দেখা রাজনীতির অন্দরমহলের চিত্র— এসব নিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা একজন একাডেমিশিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে, যা বহুকাল রাজনীতির অনুসন্ধিৎসু পাঠককে আকৃষ্ট করবে নিঃসন্দেহে।

পঞ্চাশের দশক থেকে বর্তমান সময়কালের যে চিত্র তিনি তার বইয়ে তুলে ধরেছেন, সমসাময়িক কোনো রাজনীতিবিদই তা করতে পারেননি। মওদুদ আহমদ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে তিনটি সরকারে ছিলেন। জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে। শেষের দিকে জিয়া সরকার থেকে বাদ পড়েছিলেন। তার এই রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়ে থাকে। কিন্তু এ কথা খুব কমই উচ্চারিত হয়, তিনি স্বাধীন দেশে প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলেই জেল খেটেছেন।

মওদুদ আহমদ যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স এবং বিদেশি আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে তিনি পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের জামাতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের মেয়ে হাসনা জসীম উদ্দীনের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। হাসনা জসীম উদ্দীন মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং তিনিও এরশাদ সরকারের সময়ে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হয়েছিলেন।

ব্যক্তিজীবনে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ছিলেন অমায়িক ও উদার প্রকৃতির মানুষ। ভদ্র ও সজ্জন বলতে যা বুঝায় তিনি ছিলেন তাই। একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতা তাকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। রাজনীতিতে তার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করা যেতেই পারে। কিন্তু তার পরিমিতিবোধ, সহানুভূতিশীল মানবিক হৃদয়, পাণ্ডিত্য, দেশপ্রেমবোধ— এসব গুণ আকৃষ্ট করার মতো। কোনো কর্মসূচিতে তিনি সময়ের কিছুটা আগে ছাড়া পরে উপস্থিত হতেন না। আদালতেও তিনি যেতেন ঘড়ির কাঁটা মেপে। তাকে কখনও বিলম্বে উপস্থিত হতে দেখা যেত না। একবার বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পথের দূরত্বের সঙ্গে তিনি যানজটের বিষয়টি যুক্ত করে বের হন। ফলে তিনি সময়মতো পৌঁছে যান।

তিনি ছিলেন প্রচণ্ড অধ্যবসায়ী মানুষ। কারাগারে বসেও তিনি জীবনের একটি মুহূর্তও বাহুল্য ব্যয় করেননি। রাজনীতিক মওদুদ আহমদের বাইরে তার ব্যক্তিজীবনের এ বৈশিষ্ট্য সত্যিই অনন্য।

মওদুদ আহমদ এখন জাগতিক জীবনের সব ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। কিন্তু যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছেন, মিশেছেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনেছেন, তার লেখা বই পড়েছেন, তারা তাকে মূল্যায়ন করবেন অনন্য এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। যেখানে তিনি ছিলেন উদার এবং ব্যতিক্রম একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। যার ছিল মানুষকে আকৃষ্ট করার গুণাবলি। যাকে উপেক্ষা করা যায় না। হাজারও সমালোচনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে কোনোদিন উপেক্ষা করা যাবে না।

এমএমজে/এমএআর