বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন সিরাজুল ইসলাম খান। জনসম্মুখে খুব একটা আসতেন না তিনি, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সরাসরি জড়িত ছিলেন না। এরশাদের পতনের পর আরও আড়ালে চলে যান তিনি।  

বছর কয়েক আগে ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ বইয়ে তার রাজনৈতিক ভূমিকার নানা দিক উঠে এসেছে। 

এ বইয়েরই একটি অংশে উল্লেখ রয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া তার ১৫ দফা সুপারিশমালার কথা। অবশ্য এ সুপারিশমালা শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। বইটিতে লেখা হয়েছে– আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সকলেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।

১৫ দফা সুপারিশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনের একটি সারাংশ তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। ১৫ দফা সুপারিশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সিরাজুল ইসলাম খানের আলোচনার সারাংশ- 

মুজিব : অন্য কোন দল আসবে না। সুতরাং ঐ চিন্তা বাদ দাও।
আমি :  কথাবার্তা বলতে হবে সবার সঙ্গে। তোয়াহা (কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা) ভাইকে আমি যেমন করেই হোক ম্যানেজ করবো। সিরাজ শিকদারকেও আমি আনতে পারবো।
মুজিব : আমার মনে নয় না এটা সম্ভব হবে। আমার দলের অনেকেই এটি পছন্দ করবে না।

আলোচনার এ সারাংশ তুলে ধরার পর লেখা হয়েছে- তখনকার গণভবনের সবুজ চত্বরে একদিন সন্ধ্যায় আমার কাঁধে হাত রেখে বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ হেঁটেছিলেন। এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, ‘পারলাম না রে, সিরাজ!’ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সকলেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।

আরও পড়ুন : না ফেরার দেশে রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খান

কী ছিল ১৫ দফা প্রস্তাব 

১৫ দফা প্রস্তাব প্রসঙ্গে ‘আমি সিরাজুল আলম খান বলছি’ বইটিতে লেখা হয়েছে এভাবে– 

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো একসময় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ (বিএলএফ)-এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের চারজনকে (সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ) দেশ পরিচালনার বিষয়ে একটি সুপারিশমালা দিতে বলেন। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমি ১৫-দফা কর্মসূচির একটি খসড়া তাকে দিই। নতুন রাষ্ট্রটি কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, এ কর্মসূচিতে আমি তা উল্লেখ করেছিলাম। প্রস্তাবগুলো ছিল নিম্নরূপ :

১. অসম্পূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত একটি ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ দ্বারা দেশ পরিচালিত হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সব দল ও গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত এ সরকারের প্রধান থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

২. কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হবে সশস্ত্র যুদ্ধের পরীক্ষিত নেতৃত্ব দ্বারা, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা ধারণ করেন।

৩. বঙ্গবন্ধুর মর্যাদার বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু থাকবেন সব দলের ঊর্ধ্বে। প্রয়োজনবোধে তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন। তাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে।

৪. বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হবে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনার আলোকে, কোনো দেশের অনুকরণে নয়। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সব দল ও গ্রুপের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন হবে।

৫. চিরাচরিত প্রথার সেনাবাহিনী গঠন না করে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় জাতীয় পর্যায়ে ‘রেভুল্যুশনারি (বিপ্লবী) গার্ড বাহিনী’ গঠন করা হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক, এফএফ এবং বিএলএফ-সহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এ বাহিনী তৈরি করা হবে। এর সমান্তরাল অন্য কোনো বাহিনী থাকবে না।

৬. রেভুল্যুশনারি গার্ডের মধ্যে থাকবে–
ক. বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী’, যা হবে ‘পিপলস আর্মি’।
খ. কৃষিকাজে সহায়তা দেওয়ার জন্য রেভুল্যুশনারি ‘কৃষক ব্রিগেড’।
গ. শিল্প এলাকার জন্য রেভুল্যুশনারি ‘লেবার ব্রিগেড’।

৭. নির্যাতনকারী পুলিশ বাহিনীর বদলে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’ গঠন করা হবে। ‘পুলিশ’ নামটি ব্যবহার করা হবে না।

৮. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত বন্ধ থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা-শিক্ষক-ছাত্রদের নিয়ে ছোট ছোট ‘স্কোয়াড’ তৈরি করে বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এক বছরের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষকে সাক্ষরতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

৯. উচ্চশিক্ষার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শিক্ষার জন্য ব্যাংকঋণ শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়ে পরিশোধের ব্যবস্থা থাকবে।

১০. ব্রিটিশ-পাকিস্তানি অমলের ধারাবাহিকতায় জেলা-মহকুমা-থানায় প্রশাসনের কোনো ‘ক্যাডার’ বা ‘গোষ্ঠী’কে জনপ্রশাসনের দায়িত্বে রাখা যাবে না।

১১. জনপ্রশাসনে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি জেলা-মহকুমা-থানা পর্যায়ে ‘কমান্ডার’-এর দায়িত্ব পালন করেছেন, তারাই জনপ্রশাসনের দায়িত্বে থাকবেন।

১২. জনপ্রশাসনে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আদলে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ এসব শ্রেণিবিন্যাস থাকবে না। কাজের ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য যে স্তর হয়, তা অবশ্যই থাকবে।

১৩. সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত হবে ১ঃ৭।

১৪. ‘সমবায় ভিত্তিক অর্থনীতি’ চালু হবে। পরিত্যক্ত কলকারখানা মুক্তিযোদ্ধা-শ্রমিক-কর্মচারীদের ‘সমবায়ে’র মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ‘সমবায়’-এর জন্য ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।

১৫. কেবল ভারত ও রাশিয়ার ওপর নির্ভর না করে চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্রুত কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

সূত্র : আমি সিরাজুল আলম খান বলছি

/এসএসএইচ/