নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। একইসঙ্গে বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেই ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি নামের রাজনৈতিক দল গঠন করেন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতার ভাগাভাগি ও স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের কারণে এরশাদের জীবদ্দশায় জাতীয় পার্টি ভেঙে চার টুকরা হয়। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর ভাই ও দুই স্ত্রীর দ্বন্দ্বে দুবার ভাঙন ধরে দলটিতে। তাই প্রশ্ন আসছে, জাতীয় পার্টির ভাঙনের শেষ কোথায়। এরপর কারা?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যারা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে আছেন তারা যতক্ষণ সুবিধা পাবেন ততক্ষণ দলে থাকবেন। সুবিধা না পেলে দলে থাকবেন না, তখন আবার ভাঙবে। একটা সময় জাতীয় পার্টির অবস্থা মুসলিম লীগের মতো হবে, এটাই স্বাভাবিক।

রোববার (২৮ জানুয়ারি) গুলশানের নিজ বাসভবনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন ও আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত, পার্টির বহিষ্কৃত ও অব্যাহতিপ্রাপ্ত, স্বেচ্ছায় পদত্যাগকারী নেতাকর্মীদের নিয়ে এক মতবিনিয় সভার আয়োজন করেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। সেই মতবিনিময় সভা থেকে দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন রওশন এরশাদ। সোমবার (২৯ জানুয়ারি) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের দায়িত্ব গ্রহণ এবং কমিটির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয় এ অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ।

অন্যদিকে, রোববার জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক দলটির চেয়ারম্যান কিংবা মহাসচিবসহ কোনো নেতাকর্মীকে দল থেকে বাদ দিতে পারেন না।  তার বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত আমরা আমলে নিচ্ছি না।

রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জাতীয় পার্টির জন্ম

প্রয়াত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ১৯৮৪ সালে এরশাদ প্রথমে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ‘জাগদলের’ কায়দায় ‘জনদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন করেন। যত ক্ষুদ্রই হোক অন্যান্য দলকে জনদলের সঙ্গে যুক্ত করতে চেষ্টা চালাতে থাকেন তিনি।

১৯৮৫ সালের প্রথমদিকে এরশাদ দুটি প্রধান বিরোধী জোটে ভাঙন সৃষ্টিতে সক্ষম হন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা কোরবান আলী ও বিএনপির সিনিয়র নেতা আবদুল হালিম চৌধুরীকে মন্ত্রিত্ব দেন এরশাদ। ১৫ দলীয় জোটের শরিক দল মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের খণ্ডাংশ, ৫ জোটের শরিক ইউপিপির কাজী জাফর আহমেদ এবং সিরাজুল হোসেন খানের গণতন্ত্রী দল জোট ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরই মধ্যে বিএনপির একটি অংশের নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী ও ড. এম এ মতিন এবং আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইফ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান। তার বাইরে জিয়াউদ্দিন আহমেদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মতো বিএনপির কিছু নেতা, মুসলিম লীগের একাংশের নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, দলবিহীন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও এরশাদের হাতকে শক্তিশালী করতে এগিয়ে আসেন। ফলে, জনগণের মধ্যে এরশাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।

১৯৮৫ সালের ১৬ আগস্ট এরশাদ তার জনদল, বিএনপির একাংশ, ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় ফ্রন্ট। একপর্যায়ে কাজী জাফর স্বেচ্ছায় ইউপিপি ভেঙে দিয়ে এরশাদের দলে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘সরকারি’ রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

১৯৮৫ সালে মওদুদ আহমদও বিএনপি ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে এরশাদ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তবে, জাতীয় পার্টির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় পার্টি গঠনের ঘোষণা দেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে এরশাদ পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

৬ ব্র্যাকেট বন্দি জাতীয় পার্টি, এরপর কে?

১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের সময় জাতীয় পার্টি প্রথমে তাদের সমর্থন দিলেও পরে ১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোটে চলে যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে যান এবং জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন। যেটি এখন জাতীয় পার্টি (জেপি) নামে পরিচিত।

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ আবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু তার দলের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি অংশ জোটে থেকে যায় এবং জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠিত হয়। পরবর্তীতে এ অংশের নাম হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। কিন্তু তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এরপর বিজেপি ভেঙে সাবেক মন্ত্রী এম এ মতিন করেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (এম এ মতিন)।

এরশাদের জীবদ্দশায় সর্বশেষ জাতীয় পার্টি ভেঙে বেরিয়ে যান তার পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমেদ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদকে দল থেকে বহিষ্কার করেন কাজী জাফর। আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন বিএনপি-জামায়াত জোটে। এটি জাতীয় পার্টি-কাজী জাফর নামে পরিচিত।

এরশাদের মৃত্যুর পর তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সাবেক স্ত্রী বিদিশার ইচ্ছায় ‘জাতীয় পার্টি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া’ নামের আরেকটি দল হয়। এটির বর্তমান চেয়ারম্যান বিদিশা। সর্বশেষ রোববার এরশাদের আরেক স্ত্রী রওশন এরশাদ দেবর জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি দিয়ে আরেক দফায় দলে ভাঙন ধরান।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নেতারা যারা আছেন, তারা প্রচণ্ড সুবিধাবাদী। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে তারা সব ধরনের সুবিধা নিতে চান। তাদের মধ্যে আদর্শবাদী কোনো জায়গা নেই। নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই। তাদের দলে ভাঙন হবে, বিপর্যয় হবে-এটাই স্বাভাবিক।’

তিনি আরও বলেন, স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিভিন্ন দলের নেতাদের রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধা দিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তারা বিভিন্ন সময় সুবিধা নিয়েছেন। সুবিধাবঞ্চিত হয়ে দলত্যাগ করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় এখন যারা সুবিধা পাবেন না তারা দলত্যাগ করবেন।

‘জাতীয় পার্টি এক সময় পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগে পরিণত হবে’-মনে করেন সাব্বির আহমেদ। তার মতে, ‘যে দল কতগুলো সুবিধাবাদী নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই দলের পরিণতি এমনই হয়। এযাবৎকালে নির্বাচিত হয়ে সরকারের তোষণ ছাড়া তাদের কোনো ভূমিকা নেই।’

এএইচআর/জেডএস