দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন— এমন প্রার্থীদের সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়ায় নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যারা ভোটের মাধ্যমে হেরেছেন, তাদেরকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় ‘জনগণের রায়কে উপেক্ষা করা হয়েছে’ বলে মনে করছেন অনেকে। তবে, সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি ‘দলীয় বিষয়’ বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা।

জানা গেছে, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়ায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদে দলটি ৪৮টি সংরক্ষিত আসন পাচ্ছে। বাকি দুটি আসন পাবে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এসব আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ফরম কিনেছেন এক হাজার ৫৪৯ জন। ফলে প্রতিটি আসনের বিপরীতে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ জনে। এরই মধ্যে ৪৮ জনের দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।

তাদের নামের তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, রাজনীতিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধি। কেউ কেউ আবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের নৌকা প্রতীক নিয়ে পরাজিত হয়েছেন। এ ছাড়া আসন সমঝোতার কারণে মনোনয়নবঞ্চিত একজন পেয়েছেন দলীয় মনোনয়ন।

সানজিদা খানম ও মেহের আফরোজ চুমকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদে দলের মনোনয়ন পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। ঢাকা-৪ আসনের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী সানজিদা খানমকে পরাজিত করে বিজয়ী হন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওলাদ হোসেন। অন্যদিকে, গাজীপুর-৫ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেহের আফরোজকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুজ্জামান পরাজিত করেন। জনগণের রায়ে পরাজিত হলেও তারা আবার দলের সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন

ওই তালিকায় আট কেন্দ্রীয় নেতার ঠাঁই হয়েছে। আওয়ামী লীগের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী দলের মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীরা হলেন- রেজিয়া ইসলাম (পঞ্চগড়), দ্রৌপদী দেবী আগরওয়াল (ঠাকুরগাঁও), আশিকা সুলতানা (নীলফামারী), আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা (জয়পুরহাট), কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি (নাটোর), জারা জেবিন মাহবুব (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), রুনু রেজা (খুলনা), ফরিদা আক্তার বানু (বাগেরহাট), মোসাম্মৎ ফারজানা সুমি (বরগুনা), খালেদা বাহার বিউটি (ভোলা), নাজনীন নাহার রশীদ (পটুয়াখালী), ফরিদা ইয়াসমিন (নরসিংদী), উম্মি ফারজানা ছাত্তার (ময়মনসিংহ), নাদিয়া বিনতে আমিন (নেত্রকোনা), মাহফুজা সুলতানা মলি (জয়পুরহাট), আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য পারভীন জামান কল্পনা (ঝিনাইদহ), আরমা দত্ত (কুমিল্লা), লায়লা পারভীন (সাতক্ষীরা), সদ্য সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান (খুলনা), বেদৌড়া আহমেদ সালাম (গোপালগঞ্জ), শবনম জাহান (ঢাকা), পারুল আক্তার (ঢাকা), সাবেরা বেগম (ঢাকা), আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ (বরিশাল), নাহিদ ইজাহার খান (ঢাকা), ঝর্ণা হাসান (ফরিদপুর), সদ্য সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেছা (মুন্সীগঞ্জ), শাহেদা তারেখ দীপ্তি (ঢাকা), অনিমা মুক্তি গোমেজ (ঢাকা), শেখ আনার কলি পুতুল (ঢাকা), মাসুদা সিদ্দিক রোজি (নরসিংদী), আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য তারানা হালিম (টাঙ্গাইল), আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শামসুন নাহার (টাঙ্গাইল), মেহের আফরোজ চুমকি (গাজীপুর), অপরাজিতা হক (টাঙ্গাইল), হাছিনা বারী চৌধুরী (ঢাকা), নাজমা আক্তার (গোপালগঞ্জ), রুমা চক্রবর্তী (সিলেট), আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী (লক্ষ্মীপুর), আশরাফুন নেছা (লক্ষ্মীপুর), কানন আরা বেগম (নোয়াখালী), শামীমা হারুন লুবনা (চট্টগ্রাম), ফরিদা খানম (নোয়াখালী), দিলোয়ারা ইউসুফ (চট্টগ্রাম), আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান (চট্টগ্রাম), ডরথি তঞ্চঙ্গা (রাঙামাটি), আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য সানজিদা খানম (ঢাকা) ও নাছিমা জামান ববি (রংপুর)।

দলীয় সূত্র মতে, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন ঘিরে আলোচনার সমাপ্তি ঘটলেও নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল। প্রশ্ন উঠেছে জনগণের রায় উপেক্ষার বিষয়টি। জানা যায়, অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম ও মেহের আফরোজ চুমকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদে দলের মনোনয়ন পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।  ঢাকা-৪ আসনের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী সানজিদা খানমকে পরাজিত করে বিজয়ী হন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওলাদ হোসেন। অন্যদিকে, গাজীপুর-৫ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেহের আফরোজকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুজ্জামান পরাজিত করেন। জনগণের রায়ে পরাজিত হলেও তারা আবার দলের সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, গত ১৫ বছর ধরে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এই ১৫ বছরে অনেকেই সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হয়েছেন। এবার ১৫শ মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই নতুন। পুরাতন মাত্র সাত সংসদ সদস্য স্থান পেয়েছেন। সবই ঠিক ছিল, মাত্র দুজনকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রশ্ন উঠাটা স্বাভাবিক, তবে এটাও ভেবে দেখতে হবে যে, তারা মাঠে লড়াই করেছেন। কিছু ভোট কম পেয়েছেন। নারী হিসেবে এমপি হওয়ার যোগ্য মনে করেই দল তাদের মনোনয়ন দিয়েছে। একজন তো এমপি ছিলেন, আবার তিনি দলের শীর্ষপদেও আছেন। আরেকজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন। তবে, জনগণ যাদের চায় না, তাদের না দিলেও পারত মনোনয়ন বোর্ড। অবশ্যই, মনোনয়ন বোর্ড দলীয় বিষয়গুলো মাথায় রেখে তাদের মনোনয়ন দিয়েছে— জানান তারা।

জনগণের ভোটে যারা নির্বাচিত হতে পারেননি তাদের অনেকে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। তাহলে জনগণের রায়কে উপেক্ষা করা হলো কি না— ঢাকা পোস্টের এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটা আমাদের দলের ব্যাপার। এটা আমাদের বোর্ডের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক; যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পুরুষদের ব্যাপারে কোনো স্কোপ (সুযোগ) থাকে না। নারীদের ব্যাপারে সংরক্ষিত আসনে একটা সুযোগ থাকে। এখানে জনগণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করা, না করার কোনো সম্পর্ক নেই।’

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল গতকাল রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি)। মনোনয়নপত্র বাছাই করা হবে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি। আপিল দায়ের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং আপিল নিষ্পত্তি হবে ২৪ ফেব্রুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৫ ফেব্রুয়ারি, প্রতীক বরাদ্দ ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ভোটগ্রহণ হবে ১৪ মার্চ।

এমএসআই/এমএআর