করোনার কারণে দুই বছর ধরে এমন ইফতার আয়োজন হচ্ছে না /ফাইল ছবি

করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত জনজীবন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে থমকে আছে দেশ-বিদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। রাজনৈতিক কার্যক্রমও গড়িয়েছে মাঠ থেকে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে। গত বছরের মতো এবারও করোনা আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইফতার সংস্কৃতিতে।

রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় থেকে দেশে রাজনৈতিক ইফতার সংস্কৃতি শুরু হয়। ওই সময় প্রকাশ্য রাজনীতিতে বিধিনিষেধ থাকায় ইফতার পার্টি আয়োজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের নেতারা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হতেন। ধর্মীয় ও সামাজিক এই অনুষ্ঠান পরিণত হতো রাজনীতিবিদদের মিলনমেলায়। 

তারা বলছেন, তখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বড় রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার পার্টির আয়োজন করত। পরে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলে ইফতার সংস্কৃতি চালু হয়। 

করোনা মহামারির আগে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে ইফতার পার্টির আয়োজন করতেন। ওই ইফতারে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নিতেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি বছরই তার সরকারি বাসভবন গণভবনে অন্তত আটটি ইফতার পার্টির আয়োজন করতেন। এতিম শিশু, আলেম-ওলামা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণে মিলনমেলায় পরিণত হতো গণভবন প্রাঙ্গণ। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই বছর ধরে এই আয়োজন বন্ধ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইফতারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মিলনমেলা হতো। বিভিন্ন ইফতার পার্টিতে সবার সঙ্গে সবার দেখা-সাক্ষাৎ হতো। যা দুই বছর ধরে হচ্ছে না। এটাকে খুব মিস করি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে গেছি, সেখান থেকে বাঁচতে হলে বিষয়টিকে (ভাইরাসকে) বুঝে নিজেদের করণীয় ঠিক করতে হবে। করোনা ছড়ায় এমন কাজ এখন না করাই ভালো।’

বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রমজানের ইফতার পার্টি মিস করি। করোনার কারণে এক বছরের বেশি সময় ঘরবন্দি। সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মিস করি। ইফতারও নিশ্চয়ই মিস করি। এখন কোথাও যেতে পারি না। কারো সঙ্গে তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। আশা করি, আগামী বছর এই করোনা মহামারি থাকবে না। আবার রাজনৈতিক দলগুলো ইফতারের আয়োজন করতে পারবে। সেখানে সবাই শরিক হতে পারবে। সবার সঙ্গে সবার দেখা হবে, গল্প হবে।’

করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে এতিমদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন ইফতার আয়োজন /ফাইল ছবি

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, এ বছর ইফতার পার্টি হওয়া উচিত না। পরিষ্কারভাবে বলা আছে, যেখানে লোক সমাগম বেশি হবে, ৬ ফুটের দূরত্ব মানা যাবে না, সেখানে করোনা বেশি ছড়াবে। ফলে, জেনে শুনে করোনা ছড়ানোর অংশীদার হয়ে রাজনীতি করা ঠিক হবে না।’

পাকিস্তান আমলেও ইফতার কেন্দ্রিক রাজনীতি ছিল না জানিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বাধীনতা পরবর্তীতেও দেশে ইফতারকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি হয় সেটা ছিল না। সম্ভবত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমল থেকে ইফতার কেন্দ্রিক রাজনীতি শুরু হয়েছে। আমরা কখনো এই রাজনৈতিক ইফতারের আয়োজন করি না।’

ইফতার কেন্দ্রিক আমাদের দেশে একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যেখানে মানুষের বিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে ইফতার পার্টি দূরের কথা। বেঁচে থাকলে অনেক রাজনীতি করা যাবে। অনেক ইফতার পার্টি বা সামাজিক অনুষ্ঠান করা যাবে। যখন যে পরিস্থিতি সেটার সঙ্গে মানিয়ে চলাই হচ্ছে রাজনীতিবিদের কাজ। সুতরাং ইফতার পার্টি হচ্ছে না। এটা নিয়ে হতাশ হলে চলবে না। এখন সবার দায়িত্ব হচ্ছে, কীভাবে করোনা মোকাবেলা করা যায়, সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা।’

বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে গণভবনে এতিম, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সৌজন্যে ইফতারের আয়োজন হতো। আর সংসদের বিরোধী দলের নেতা থাকাকালে মিন্টু রোডের বিরোধী দলীয় নেতার বাড়ির বাইরে একই নিয়মে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হতো।

তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সাল থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রথম রমজানে রাজধানীর লেডিস ক্লাবে এতিমদের সঙ্গে ইফতার করতেন। ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেও একই নিয়মে এতিমদের সৌজন্যে প্রথম রমজানে বিএনপির নেতারা ইফতারের আয়োজন করতেন। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর ধরে সেটা বন্ধ হয়ে আছে।’

করোনার কারণে এতিমদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার ইফতার আয়োজনও বন্ধ রয়েছে /ফাইল ছবি

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শুধু ইফতার পার্টি বা রাজনীতি নয়, স্বাভাবিক জীবনটাকে মিস করছি। এখন আমরা সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল কিছুই করতে পারছি না। শুধু আমরা নই, বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই এখন স্বাভাবিক নিয়মে চলতে পারছেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজনীতির আগে জীবন। এখন ইফতার পার্টি বা সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে হবে। আশা করি একদিন এই মহামারি থাকবে না। তখন আবার ইফতার ও ঈদ কেন্দ্রিক সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো করা যাবে।’ 

আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে ইফতার পার্টির প্রচলন শুরু হয়। করোনার এই সময়ে ইফতার পার্টি হচ্ছে না। তবে আমি মনে করি, করোনা-মুক্ত বাংলাদেশে ইফতার পার্টির এই সংস্কৃতি ফিরে আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

এইউএ/এএইচআর/ওএফ/জেএস