তারেক রহমানের ঘরে ফেরা
৩০০ ফিটে সংবর্ধনা মঞ্চ ঘিরে রাজকীয় প্রস্তুতি
দীর্ঘ ১৭ বছর পর নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরবেন তিনি। ফ্লাইটটি বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায়) লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে। সফরসঙ্গী হিসেবে তার সঙ্গে থাকছেন সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান। আরও থাকছে তাদের আদরের পোষা বিড়াল ‘জেবু’।
সব ঠিক থাকলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে। ঢাকায় অবতরণের আগে উড়োজাহাজটি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ঘণ্টা যাত্রা বিরতি করবে।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। বিমানবন্দর থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও প্রটোকলে সংবর্ধনা নিতে যাবেন পূর্বাচল ৩০০ ফিট এলাকার মঞ্চে। সেখানে তারেক রহমানের সঙ্গে মঞ্চে দলীয় নেতাদের পাশাপাশি থাকবেন দীর্ঘ সময়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের যুগপৎ সঙ্গী শরিক দলের শীর্ষ নেতারা। তবে, মঞ্চে শুধু মাত্র তারেক রহমানই বক্তব্য রাখবেন।
বিজ্ঞাপন
৩০০ ফিটে সংবর্ধনা মঞ্চকে ঘিরে রাজকীয় প্রস্তুতি
দলের শীর্ষ নেতা তারেক রহমানকে বরণ করে নিতে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিএনপি। রাজধানীর কুড়িল মোড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে জুলাই-৩৬ সড়কের উত্তর অংশে দক্ষিণমুখী করে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ৪৮ ফুট বাই ৩৬ ফুটের বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এই মঞ্চে থেকে প্রায় ১৮ বছর সশরীরে আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেবেন তারেক রহমান।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্বরোড মোড় থেকে পূর্বাচলমুখী সড়কের উত্তর অংশে দক্ষিণমুখী করে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছে ৪৮ ফুট বাই ৩৬ ফুটের বিশাল মঞ্চ। এখন অপেক্ষা শুধু তারেক রহমানের আগমনের।
আরও দেখা গেছে, ৪৮ বাই ৩৬ ফিট আকারের বিশাল মঞ্চে বসানো হয়েছে এলইডি স্কিন। সেখানে বাংলাদেশে জাতীয় পতাকার প্রতিচ্ছবির ওপর লেখা রয়েছে ‘তারেক রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মঞ্চে অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিরাপত্তায় নিজস্ব বিশেষ সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা।
মঞ্চ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত লাগানো হয়েছে কয়েকশ’ মাইক। বিভিন্ন নেতাদের উদ্যোগে তারেক রহমানকে স্বাগত বার্তা সম্বলিত নানা আকারের ব্যানার টাঙানো হয়েছে এয়ারপোর্ট সড়ক থেকে শুরু করে পুরো মঞ্চ এলাকা। ৩০০ ফিট সড়কের গাছ যাতে নষ্ট না করা হয়, তার জন্য ছাত্রদলের সহ-সভাপতি এইচ এম আবু জাফরের সৌজন্যে গাছে গাছে ঝোলানো হয়েছে গাছ রক্ষা বিষয়ক নানা বার্তা।
কর্মীরা স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছে মঞ্চের আশপাশ। তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও তাদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। কেউ কেউ অভিনব উপায়ে ধানের শীষ দিয়ে তৈরি পোশাক পরে অন্যদেরও উজ্জীবিত করছেন। কেউ মাথায় ধানের শীষ দিয়ে তৈরি মাথাল পরে গানের তালে তালে নাচতে দেখা গেছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের হাতে শোভা পাওয়া জাতীয় পতাকা ও বিএনপির দলীয় পতাকায় পুরো এলাকা লাল-সবুজে ভরে উঠেছে।
অনুষ্ঠানকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুরো এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যৌথ বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে। মঞ্চের সামনে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও টহল দিতে দেখা গেছে। সেনাবাহিনীর একাধিক টিম গাড়িতে করে দফায় দফায় পুরো সমাবেশ এলাকা পরিদর্শন করছে। এছাড়া মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি।
এরই মধ্যে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে আগত বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ৩০০ ফিট এলাকায় অবস্থান নিয়েছেন। তারা ব্যানার ও ত্রিপল বিছিয়ে সড়কের ফুটপাতে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে নিয়েছে। নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে একদিন আগেই পুরো এলাকা উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। পাশাপাশি পতাকা, ব্যাজ, মাথার ব্যান্ডসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের মেলাও জমে উঠেছে। অস্থায়ী খাবারের দোকানও চালু হয়েছে। ফুটপাতের ওপরে বিরিয়ানি রান্না চলছে।
দিনাজপুর ঘোড়াঘাট পৌর ছাত্রদলের সদস্য মুরসালিন রহমান, বিল্লু রহমান ও সিয়াম জানান, তারা পৌর ছাত্রদলের পক্ষ থেকে ৮০ জনের একটি দলের সঙ্গে গত মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন তারেক রহমানকে বরণ করে নিতে।
মুরসালিন রহমান রহমান বলেন, ‘আমাদের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। ছাত্রদলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই নেতাকে দেশের বাইরে দেখেছি। এবার সামনে থেকে দেখতে পাব, এটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো।’
সাধারণ মানুষের মধ্যেও তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। পূর্বাচল, কুড়িল, এয়ারপোর্ট এলাকার বাসিন্দারাও সন্তানদের নিয়েও মঞ্চ দেখতে আসেন।
রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না, কিন্তু তারেক রহমান দেশে ফিরছেন এইটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই দেখতে আসছি কেমন প্রস্তুতি নিয়েছে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য সচিব রুহুল কবির রিজভী আশা প্রকাশ করে বলেন, তারেক রহমানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের সমাগম হতে পারে।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারেক রহমানের প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হলো সরাসরি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার গুরুতর অসুস্থ মা খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়া। তবে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান জানিয়ে, যাত্রাপথের মাঝামাঝি রাজধানীর ‘জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে’ (৩০০ ফিট) এলাকায় দলের পক্ষ থেকে তৈরি করা গণ অভ্যর্থনা মঞ্চে তিনি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন। সেখান থেকে হাসপাতালে গিয়ে মায়ের পাশে থাকবেন।
বুধবার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ বিমানের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন তারেক রহমান। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ৩০০ ফিট এলাকায় গণ অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে নেতাকর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেবেন। এরপর সেখান থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে মাকে দেখতে যাবেন। সেখানে মায়ের পাশে একান্তে কিছু সময় কাটাবেন। পরে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসায় উঠবেন তারেক রহমান।’
দীর্ঘ দেড় যুগ পর তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘিরে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গন, নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ, কৌতূহল ও আবেগের সঞ্চার হয়েছে।
১/১১ সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার হন তারেক রহমান। রিমান্ডে থাকাকালীন তার ওপর চালানো হয় অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্ত হোন। ১৮ মাস কারাভোগের পর লন্ডনে যান চিকিৎসার জন্য। এর পর কেটেছে ১৭ বছরেরও বেশি দীর্ঘ এক নির্বাসিত জীবন।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুর্নীতির ‘মিথ্যা’ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয় এবং ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে কারাবরণ করতে হয়। তার অনুপস্থিতিতে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে দলের হাল ধরেন তারেক রহমান। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। এর পর থেকেই গুম-খুন আর নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে দিন-রাত এক করে কাজ চালিয়ে যান তারেক রহমান।
দীর্ঘ সময় সুদূর যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত থাকলেও দলীয় সিদ্ধান্ত, কৌশলগত পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক নির্দেশনায় এখন তিনি বিএনপির প্রধান চালিকাশক্তি। দলটির শীর্ষস্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলার সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তার নির্দেশনা মেনে চলছেন। তার রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে দলের কর্মী-সমর্থকেরা খুঁজে পাচ্ছেন দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে।
তার এই প্রত্যাবর্তনে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। তাদের বিশ্বাস, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন দীর্ঘ রাজনৈতিক টানাপড়েনের পর দলকে নতুন করে সংগঠিত করবে। পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে তৈরি হবে নতুন বাস্তবতা।
তারেক রহমানের সঙ্গে মঞ্চে থাকবেন যুগপৎ সঙ্গীরা
তারেক রহমানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিএনপির বাইরেও দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সঙ্গী যুগপতের সঙ্গীরাও থাকবেন। জানা গেছে, যুগপতের নেতাদের সংবর্ধনা মঞ্চে উপস্থিত থাকতে গুলশান বিএনপির চেয়ারপারসের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে ‘বিশেষ কার্ড’ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সকাল ১০টার মধ্যে তাদের মঞ্চে যেতেও অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তিনিসহ গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতাদের সংবর্ধনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারেক রহমানকে বরণে গোটা জাতি প্রস্তুত।’
দেশে ফেরার পর ২ দিনের কর্মসূচি চূড়ান্ত
দেশে ফেরার পরদিন শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) জুমার পর শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে যাবেন তারেক রহমান। সেখানে জিয়ারত শেষে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।
শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) প্রথমে জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ ও ভোটার হবেন তারেক রহমান। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরিফ ওসমান হাদির কবর জিয়ারত শেষ করে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি।
এএইচআর/এসএম