রাজনীতির মঞ্চে ঘুরে-ঘুরে ব্যস্ত সময় কাটানো প্রবীণ রাজনীতিবিদদের জীবনে সীমাহীন অবসর এনে দিয়েছে মহামারি করোনা। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে শুরু থেকেই নিজেদের স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি করে রেখেছেন দেশের অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। তবে দীর্ঘ এ অবসর আর সহ্য হচ্ছে না তাদের। তারা চান দ্রুতই যেন আগের অবস্থায় ফিরে আসে পৃথিবী আর তারাও ফিরতে পারেন নেতাকর্মীদের মাঝে।

প্রবীণ এসব রাজনীতিবিদরা বলছেন, জীবনে অনেক কঠিন সময় পার করেছেন। কিন্তু কখনো এ রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি যেখানে মানুষ-মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারেন না। 

অবসর জীবনে বাসায় নামাজ আদায়, বই ও পত্রিকা পাঠ এবং আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে গল্প করে সময় পার করছেন তারা। কেউ আবার লেখালেখি করে অবসর সময় কিছুটা হলেও কাজে লাগাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রযুক্তির মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন।   

বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। একসময় রাজনীতি আর হাসপাতালে রোগী দেখে সময় কাটাতেন। কিন্তু দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে নিজেকে গৃহবন্দি করে রেখেছেন তিনি। আছেন রাজধানীর বারিধারার নিজের বাড়িতে।

কেমন আছেন জানতেচাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, গৃহবন্দি জীবনে কেমন থাকি বলেন? তারপরও বলব ভালো আছি।খুব কষ্টের সময় কাটছে। দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থাকলে তো আর ভালো লাগে না। তারপরও বাসায়আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে গল্প করি, আড্ডা দিই। মাঝে মাঝে আমার লেখা বইগুলো পড়ি, নতুন করেকিছু লেখালেখি করি। এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছে।

গৃহবন্দি থাকলেও ভিডিও কলে নিয়মিত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন উল্লেখ করে বি. চৌধুরী বলেন, মাঝে মাঝে আমার ডাক্তাররা রোগীর বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে আমাকে ফোন করেন। আমি তাদের করণীয় সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে থাকি। আবার ভিডিও কলে রোগী দেখি।

প্রবীণ এই রাজনীতিবিদবলেন, এলাকায় এক বিঘা জমি আছে। সেখানে সবজি বাগান করা হয়েছে। এই বাগানে আমি ভিডিও কলেনির্দেশনা দিই, সেই অনুযায়ী তারা কাজ করে। বাগানে লাল শাক, পালং শাক, পুঁই শাক চাষকরা হয়েছে। ৭ দিন পর-পর আমাদের গাড়ি গিয়ে সেগুলো নিয়ে আসে। অনেক ড্রাগন ফলও হয়েছে।সেগুলো নিজেরা খাই। কিছু ভাই-বোনদের বাসায় পাঠাই। আর ঢাকার বাসার ছাদেও কিছু ফুল গাছ লাগিয়েছি।এগুলোর পরিচর্যা করেই দিন কেটে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভীষণরকম ‘মিস’ করেন উল্লেখ করে ৮৮ বছর বয়সী এ রাজনীতিবিদ বলেন, এখন কোথাও যেতে পারি না। কারো সঙ্গে তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। আশা করি, আবার সবার সঙ্গে দেখা হবে, গল্প হবে।

করোনা প্রাদুর্ভাবের পর বাসা থেকে বের হন না আরেক প্রবীণ রাজনীতিবিদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। এই মুহূর্তে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। ঢাকা পোস্টকে জমির উদ্দিন বলেন, বাড়িতে বসে থাকি, আর কী করব? অনেক বয়স হয়েছে। আর করোনাভাইরাস তো বয়স্কদের জন্য খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই বাসায় থাকি। নিজের রুমেই থাকি। বাসায়ও খুব সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার চেষ্টা করি। কারো সঙ্গে তেমন একটা মেশা হয় না। 

গান শুনে, বই পড়ে সময় কাটে উল্লেখ করে ৯০ বছর বয়সী বিএনপির এই নেতা বলেন, দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভাগুলোয় যুক্ত হই। আশা করি, একদিন পৃথিবী আগের মতো হবে। বেঁচে থাকলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব।

ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন বলেন, টিকা নেওয়ার জন্য শুধু বাইরে গিয়েছিলাম। এছাড়া আর বাসার বাইরে যাওয়া হয়নি।  কোর্ট, রাজনীতি সবকিছু মিস করি। কিন্তু করার তো কিছু নেই।

গণফোরামের সভাপতি এবং বাংলাদেশের সবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। রাজধানীর বেইলি রোডের বাসায় একরকম ঘরবন্দি জীবনে আছেন তিনি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে গৃহবন্দি হয়ে থাকা ছাড়া তো আর কিছু করারনেই। চলাফেরা বন্ধ, কারও সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে টেলিফোনে কথাবার্তা বলা ছাড়া তো অন্যকিছু করা যাচ্ছে না। দেশের স্বাধীনতার সময় জেলেছিলাম। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতি ছিল না। একটা অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে আছি।

তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসুক সেটাই চাই। সবাই মিলে সেই চেষ্টাই করতে হবে। দেশের অর্থনীতির অবস্থা তো খারাপ হচ্ছে। আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে গেছি, সেখান থেকে বাঁচতে হলে ভাইরাসকে বুঝে নিজেদের করণীয় ঠিক করতে হবে।

করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছেন উল্লেখ করে ৮৪ বছর বয়সী এ রাজনীতিবিদ বলেন, ভাগ্য ভালো যে আগেই টিকা নিয়েছিলাম। দুই ডোজই নেওয়া হয়েছে। এখন টিকা নিয়ে প্রতিদিনই নানা রকম সংকটের কথা শোনা যায়। তারপর দেখছি সরকার প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে টিকা আনার চেষ্টা করছে।

ড. কামাল হোসেন বলেন, গান শুনে, বই পড়ে দিনের বেশিভাগ সময় কাটে। বই পড়ে নতুন অনেক কিছু জানতে পারছি। এর বাইরে টেলিভিশন দেখি, বিকেলে বাইরে বসে সময় কাটানোর চেষ্টা করি। আগে ঈদের সময় অনেক নেতাকর্মী দেখা করতে আসতেন। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে গত কয়েকটি ঈদ একদম ঘরবন্দি কেটেছে। নিজেও কোথাও যাইনি। দারুণ কষ্টে দিন কাটছে। রাজনীতি খুব মিস করি। আশা করি, সবকিছু স্বাভাবিক হলে আবার সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হবে। 

প্রবীণ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীও করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় ধরে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হয়ে আছেন। এই মুহূর্তে ফরিদপুরের বাড়িতে আছেন তিনি। তার ছেলে-মেয়েরাও তাকে বাসার বাইরে যেতে দেন না। তাই গান শুনে, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটছে ৮৬ বছর বয়সী এ রাজনীতিবিদের। 

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, শারীরিকভাবে আম্মা ভালো আছেন। কিন্তু যেহেতু বয়স হয়েছে তাই আগের মতো অবস্থা নেই। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে আমরা আম্মাকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। কারণ এই রোগটি তো বয়স্ক মানুষের জন্য বেশি বিপদজনক। তাই ওনাকে সাবধানে রাখার চেষ্টা করছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা আম্মাকে নেতাকর্মীদের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। তিনি যেহেতু নেতৃত্ব দেওয়া মানুষ, তাকে দেখলে সাধারণ মানুষ একটু কাছে যেতে চায়, কথা বলতে চায়। কিন্তু আমরা যখন তাকে মানুষজন থেকে দূরে রাখি তখন ওনার মন খারাপ হয়। সেটা তিনি পছন্দ করেন না। আসলে আমরা ভাই-বোনরা ছাড়া কাউকে তার সঙ্গে মিশতে দেওয়া হয় না। 

শাহদাব আকবরলাবু বলেন, আম্মা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েছেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অফিসের কোনোফাইল থাকলে সেগুলোতে স্বাক্ষর করে দেন। এর বাইরে গান শুনে, গল্প করেই দিন কাটে আম্মার।আসলে করোনা আসার পর থেকে তাকে আমরা ঘরের বাইরে যেতে দিচ্ছি না। 

দীর্ঘ সময় গৃহবন্দি থেকেও করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাননি খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক। তিনি বলেন, গত বছর থেকে পাবনায় আছি। মাঝে করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৬ দিনের মতো একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর আবার অন্য রোগে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। অস্ত্রোপচারও করতে হয়েছে। বাড়িতে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটছে। কয়েকটি পত্রিকা পড়ি প্রতিদিন। আমার নাতি মোবাইলে কিছু কিছু খবর দেখায়। এভাবেই কেটে যাচ্ছে সময়।

৯২ বছর বয়সী মাওলানা ইসহাক বলেন, বাড়ির বাইরে যাওয়া হয় না। ঘরেই নামাজ পড়ি। কারণ দুর্যোগের সময় আপনাকে নিজের মেধা খরচ করে চলতে হবে।

এএইচআর/এসকেডি/জেএস