‘মাল্টি- ট্রিলিয়ন মহাকাশ অর্থনীতি, বাংলাদেশ কতোটা প্রস্তুত’ শীর্ষক আলোচনা

মহাকাশ প্রযুক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দিতে পারে। মাল্টি-ট্রিলিয়ন ডলারের এই অর্থনীতির এক শতাংশের কম ভাগ পেলেও বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের চেয়ে বেশি উপার্জনের পথ উন্মোচিত হবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার আগে বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা এবং নীতিমালা তৈরিরও পরামর্শ দেন তারা।

কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুন দেশ’-এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগরের সঞ্চালনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রচারিত ‘শওগাত আলী সাগর লাইভ’ অনুষ্ঠানে তারা এই মতামত দেন। স্থানীয় সময় বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে ‘মাল্টি- ট্রিলিয়ন মহাকাশ অর্থনীতি, বাংলাদেশ কতোটা প্রস্তুত’ শীর্ষক এই আলোচনায় বক্তব্য রাখেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার অধ্যাপক ড. ইকরাম হোসেন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিআইডিএ) সাবেক মহাপরিচালক তৌহিদুর রহমান খান এবং হিউষ্টন ভিত্তিক দ্যা ভার্চুয়াল আমেরিকান কোম্পানিজ এল এলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ শামীমুজ্জামান।

মহাকাশ অর্থনীতির আয়তন ১ ট্রিলিয়ন ডলার হলে, বাংলাদেশ তার ১ শতাংশ পেলেও আয় হবে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ শামীমুজ্জামান

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ শামীমুজ্জামান আলোচনায় যুক্ত হয়ে মহাকাশ প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা এখন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতের মহাকাশ অর্থনীতির আয়তন যদি ১ ট্রিলিয়ন ডলার হয়, বাংলাদেশ তার মাত্র ১ শতাংশ পেলেও ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হবে। যা বর্তমানের প্রবাসী আয়ের চেয়েও বেশি।

তিনি বলেন, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে মহাকাশে ৬০ হাজারের বেশি স্যাটেলাইট ছাড়া হবে। তখন এই মহাকাশই হবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সোনা আহরণের ক্ষেত্র। এই স্যাটেলাইটগুলোর সার্ভিসিং দিয়েই একটি দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেওয়া যায় বলে তিনি মত দেন।

রকেট উৎক্ষেপণ পোর্টের সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হতে পারে বাংলাদেশ।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ শামীমুজ্জামান

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ শামীমুজ্জামান বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার কারণে রকেট উৎক্ষেপণ পোর্ট তৈরি করে ভাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হতে পারে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক জোনে রকেট অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্টও স্থাপন করা যায়। মহাকাশ ভিত্তিক নতুন ধরনের ইন্টারনেট ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কিং, স্যাটেলাইট নির্ভর ডিভাইস আর অ্যাপস তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশ মহাকাশ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত হতে পারে।

শামীমুজ্জামান বলেন, আমরা এটিকে উচ্চাভিলাষ বা স্বপ্ন হিসেবে দেখছি না। এটিকে আমরা বাস্তব হিসেবেই ভাবতে চাই। ত্রিশ বছর আগে যখন বলা হতো, কম্পিউটার হচ্ছে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ, তখনও অনেকে বলতেন- বাংলাদেশ এগুলো পারবে না। সেটি কিন্তু এখন বাস্তবতা। বেসরকারিখাতের হাত ধরে বাংলাদেশের ইন্টারনেট এসেছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেটার পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। মহাকাশ প্রযুক্তিভিত্তিক অর্থনীতিও আগামী দিনের বাস্তবতা। কিন্তু এখন পদক্ষেপ না নিলে পরে পস্তানো ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই এই বাণিজ্যে ঢোকার পদক্ষেপ না নিতে পারলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পেছনে পরে যাবে।

অনেক মেধাবী বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করছেন। দেশেও যথেষ্ট প্রতিভাবান তরুণ আছেন।

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির সাবেক মহাপরিচালক তৌহিদুর রহমান খান

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির সাবেক মহাপরিচালক তৌহিদুর রহমান খান বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু কিছু দীর্ঘসূত্রতা বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগকারীদের জন্য সোনার খনি।ফলে নতুন কোনো ধরনের সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিখাতে বিনিয়োগের আলোচনা উঠলে বিদেশি বা দেশি বিনিয়োগকারী পেতে কোনো সমস্যা হবে না। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ সক্ষমতা এবং আগ্রহ দুই আছে, তবে সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মহাকাশ প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে স্বপ্ন নয় বাস্তব হিসেবে অভিহিত করে তৌহিদুর রহমান খান বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক মেধাবী এবং দক্ষ বাংলাদেশি এই খাতে কাজ করছেন। দেশেও যথেষ্ট প্রতিভাবান তরুণ আছেন। বিদেশি কোম্পানিগুলোও বাংলাদেশের বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী। প্রয়োজন কেবল সরকারের সিদ্ধান্ত এবং কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। নীতিমালা না থাকলে কেউ এখানে কাজ করতে এগিয়ে আসবে না।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এখনই মহাকাশ প্রযুক্তি বিষয়ক পাঠ্যক্রম যুক্ত করা দরকার।

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার অধ্যাপক ড. ইকরাম হোসেন

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার অধ্যাপক ড. ইকরাম হোসেন মহাকাশ প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর পাঠ্যসূচিতে এখনই মহাকাশ প্রযুক্তি বিষয়ক পাঠ্যক্রম যুক্ত করা দরকার।

মহাকাশ প্রযুক্তি এবং অর্থনীতিতে দাঁড়াতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে যেতে বলে উল্লেখ করে ড. ইকরাম হোসেন বলেন, আমেরিকা চীনই যে এই অর্থনীতির শীর্ষে রয়েছে তা নয়, প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানও ইতিমধ্যে মহাকাশ প্রযুক্তির খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমেছে। চীনের পাশাপাশি এই দেশগুলোর সঙ্গেও বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতা করতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে জনশক্তি। পরিকল্পিত নীতিমালার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি সরকার, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি কর্মকৌশল তৈরির পরামর্শ দেন।

সম্ভাবনাময় মহাকাশ অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আরও বেশি আলোচনা হওয়া দরকার।

‘নতুন দেশ’-এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর

‘নতুন দেশ’-এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর বলেন, সম্ভাবনাময় মহাকাশ অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আরও বেশি আলোচনা হওয়া দরকার, যাতে জনগণ এবং সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন। 

তিনি বলেন, প্রযুক্তির দুনিয়ায় প্রবেশের ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অতীতে সাবমেরিন কেবল প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীনতায় জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। মহাকাশ প্রযুক্তির ব্যাপারে যেন অতীতের সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

এইচকে