যেকোনো দেশের ব্যাপারে কথা বলার জন্য কার্যকর কূটনৈতিক চ্যানেল আছে, সেই চ্যানেলের বাইরে গিয়ে কথাবার্তা বলা বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ গ্রহণযোগ্য নয়।

সাবেক কানাডিয়ান কূটনীতিক সৈয়দ জুলফিকার সাদেক এমন মতামত দিয়ে বলেছেন, কূটনৈতিক চাপ আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যটা কোনো রাষ্ট্রদূত বুঝতে না পারলে সেটা হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত হবে সে ব্যাপারে কথা বলার কোনো অধিকারই অন্য দেশের নেই। তবে উন্নয়ন সহযোগী বা বন্ধুদেশগুলো যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের পরামর্শ বা মতামত প্রকাশ করতে পারে।

‘নতুনদেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগরের সঞ্চালনায় ‘শওগাত আলী সাগর লাইভ’ এর আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।

কানাডার স্থানীয় সময় রোববার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত ‘কূটনীতিকের দায় এবং দায়িত্বের সীমারেখা’ শীর্ষক এই আলোচনায় তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কানাডা সরকারের হয়ে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা তুলে ধরেন।

বাংলাদেশি কানাডিয়ান সৈয়দ জুলফিকার সাদেক ৩৩ বছরের কূটনৈতিক জীবনে কানাডা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নয়াদিল্লিসহ বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। আলোচনায় তিনি বাংলাদেশে যাতে কোনো বিদেশি কূটনীতিক অসম্মানিত না হন বা নিরাপত্তাহীন বোধ না করেন সেটি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

দায়িত্ব পালনে কূটনীতিকদের দায় এবং দায়িত্বের সীমারেখা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সৈয়দ জুলফিকার সাদেক বলেন, কোনো দেশে দায়িত্ব পালনকালে একজন কূটনীতিকের কর্মপরিধি, দায়-দায়িত্ব ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনে স্পষ্ট করা আছে। এটি আন্তর্জাতিক একটি চুক্তি এবং এর বিধান অনুসরণের বাধ্যবাধকতা আছে। এমনকি একজন কূটনীতিক তার নিজ দেশে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাঠাবেন সেটির গোপনীয়তার বাধ্যবাধকতাও এই কনভেনশনে স্বীকৃত আছে। কাজেই একজন কূটনীতিক চাইলেই কোনো দেশ সম্পর্কে নিজ দেশে কী তথ্য পাঠাচ্ছেন তা মিডিয়ায় বা অন্য কোনো ফোরামে প্রকাশ করতে পারেন না।

তিনি বলেন, কোনো দেশে দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্রদূতরা কেবল সরকার বা সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন না, বিরোধী দল, এনজিও, সুশীল সমাজসহ নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু কূটনৈতিকভাবে কোনো কিছুর জন্য চাপ দেওয়া আর এমনভাবে কিছু বলা যেটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে— এই দুটি বিষয়ের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্যটা একজন কূটনীতিককে অনুসরণ করতে হয়।

নয়াদিল্লিতে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, নয়াদিল্লিতে দায়িত্বরত থাকা অবস্থায়ই গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, কিন্তু সেই দাঙ্গা নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা ভারত সরকারের উদ্দেশে কোনো বক্তব্য রাখেননি।

তিনি বলেন, সে সময় কেন্দ্রে এবং প্রদেশে বিজেপি সরকার ক্ষমতায়। কূটনীতিকরা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন, নিজ নিজ দেশে পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন কিন্তু ভারত সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনা বা প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া তারা দেখাননি। তিনি উল্লেখ করেন, ভারত সরকার তাদের কোনো বিষয়ে কূটনীতিকরা কথা বলুক সেটা হতে দিত না। তিনি বলেন, আমরা কূটনৈতিক ভাষায় বলেছি, আমরা আশা করি সরকার সব জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

এ প্রসঙ্গে তিনি ট্রাম্পের শাসনামলে একজন ব্রিটিশ কূটনীতিককে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ট্রাম্পের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করায় আমেরিকার চাপে তাকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার।

ভেনেজুয়েলায় আমেরিকান কূটনীতির ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভ্যানেজুয়েলার নির্বাচন যথাযথ হয়নি অভিযোগ করে আমেরিকা অনেকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, এমনকি বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত প্রতিনিধি এমন ঘোষণাও দেয়। কিন্তু এখন আবার আমেরিকা নিজেরাই সেই সব নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।

সৈয়দ জুলফিকার সাদেক বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার— এগুলো অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে। এগুলো বাংলাদেশকেই করতে হবে। বাইরের কেউ এসে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না।

আলোচনায় ‘নতুনদেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর বলেন, রাজনীতিকরাই বিদেশিদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দেয়। যখন যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা বিদেশিদের সহায়তায় ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে দেশের স্বকীয়তা নষ্ট হয়। তিনি কূটনীতিকদের নিজস্ব সীমানায় থেকে বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

/এসএসএইচ/