করোনা মহামারিতে অর্থনীতির মন্দাবস্থার মধ্যে কানাডায় রিয়েল এস্টেট মার্কেটের ঊর্ধ্বগতিকে অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মানুষের হাতে বাড়তি সঞ্চয় থাকায় ও ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমানোয় মানুষ বাড়ি কেনায় আগ্রহী হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহকের চাহিদার তুলনায় বিক্রিযোগ্য বাড়ির সংখ্যা কম হওয়ায় দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগরের সঞ্চালনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ‘শওগাত আলী সাগর লাইভে’ কানাডার রিয়েল এস্টেট মার্কেটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বক্তারা এ মত দেন।

স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ মার্চ) রাতে ‘কানাডার রিয়েল এস্টেট মার্কেটের ভবিষ্যৎ কী’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন অর্থনীতিবিদ, অ্যাডমন্টনের ম্যাকইউয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রাফাত আলম, রিয়েল্টর ও বাংলা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী সাজ্জাদ আলী এবং সাংবাদিক মনজুর মাহমুদ। 

আলোচকরা রিয়েল এস্টেট মার্কেটে বিনিয়োগে আগ্রহীদের নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা এবং আগামী পাঁচ বছরে নিজের আয়-ব্যয়ের সম্ভাব্য গতি প্রকৃতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন।

অর্থনীতিবিদ ড. রাফাত আলম কানাডার সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরে বলেন, করোনার কারণে অর্থনীতিতে প্রবল চাপ তৈরি হলেও দেশ এখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভ্যাকসিন দেওয়া শেষ হলেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যাবে এবং বর্ধিত প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

কানাডার রিয়েল এস্টেট মার্কেটের বর্তমান অবস্থাকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন ড. রাফাত আলম। তিনি বলেন, কানাডিয়ানরা এখন নগদ ডলারের ওপর বসে আছে। পরিসংখ্যান বলছে, কানাডিয়ানদের হাতে ১০০ বিলিয়ন ডলার বাড়তি সঞ্চয় অলস পড়ে আছে, যেগুলো বিনিয়োগের জন্য পথ খুঁজছেন তারা। তিনি বলেন, করোনার সময় সরকারের দেওয়া প্রণোদনার অর্থ নাগরিকদের অর্থ প্রবাহকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সময়ে মানুষের অন্যান্য বয় কমে গেছে। ফলে সঞ্চয় বেড়েছে, মানুষের হাতে নগদ অর্থ জমা হয়েছে। এই অর্থ তারা রিয়েল এস্টেট এবং শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করছেন।

তিনি বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের রিয়েল এস্টেট মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিজের আয়ের সঙ্গে সম্ভাব্য ঋণের আনুপাতিক হার পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়ে বলেন, কোনো অবস্থাতেই যেন ঋণের পরিমাণ মোট আয়ের এক তৃতীয়াংশের বেশি না হয়। 

রিয়েল্টর সাজ্জাদ আলী রিয়েল এস্টেট বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিকে অস্বস্তিকর আখ্যা দিয়ে বলেন, গত ২০ বছরের পেশাগত জীবনে বাড়ির দাম নিম্নমুখী হতে কখনও দেখিনি। আবার এমন লাফিয়ে বাড়তেও দেখিনি। সব সময় একটা নির্দিষ্ট গতিতে বাড়ির দাম উপরের দিকে গেছে।

বর্তমান বাজারে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ক্রেতার আধিক্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আর্থিকভাবে মানুষের সক্ষমতা বেড়ে গেছে, তাদের হাতে নগদ অর্থও বেড়েছে। ২০ বছর আগে টরন্টোর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বছরে ৩০ হাজার ডলার আয় করেন এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হতো। এখন একশ বা দেড়শ হাজার ডলারের বেশি আয় করেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা অনেক। সাজ্জাদ আলী বলেন, বাংলাদেশিদের চেয়ে আয়তনে বড় অন্যান্য কমিউনিটিতেও এভাবে বিত্তশালীর সংখ্যা বেড়েছে।

তিনি যাদের সক্ষমতা আছে তাদের এখনই রিয়েল এস্টেট মার্কেটে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিনিয়োগের আগে অবশ্যই নিজের আর্থিক শক্তি, আগামী দিনে ব্যক্তিগত আয়ের প্রবাহের ধারাবাহিকতা বিবেচনায় নিতে হবে। 

সাংবাদিক মনজুর মাহমুদ বর্তমান বাজারকে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, একটি বাড়ি বিক্রির জন্য তালিকাভুক্ত, সেটি নিয়ে বিডিংয়ের নামে দরের যুদ্ধ (প্রাইস ওয়ার) শুরু হয়ে যায়। এর মাধ্যমে বাড়ির দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ফেলা হয়। বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব সক্ষমতাকে প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পাঁচ বছর পর নিজের আর্থিক সক্ষমতা কোন পর্যায়ে যাবে, সেটি বিবেচনায় নিয়েই রিয়েল এস্টেট মার্কেটে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

সাংবাদিক মনজুর মাহমুদ কানাডার রিয়েল এস্টেট মার্কেটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা অর্থের প্রবাহসহ নানা ধরনের কালো বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সাধারণ নাগরিকরা নিজের থাকার জন্য কিংবা বিনিয়োগ হিসেবে রিয়েল এস্টেট মার্কেটের দিকে ঝুঁকলেও কানাডার কালো অর্থনীতির একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই রিয়েল এস্টেট খাত।

নতুনদেশের প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর রিয়েল এস্টেট মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের হোমওয়ার্ক এবং রিসার্চ করে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যেকোনো বিনিয়োগই সাধারণ মানুষের জন্য জটিল এবং দুর্বোধ্য। কাজেই সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের উচিত ক্রেতাদের শিক্ষিত করে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া।

এসএসএইচ