বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের আজ জন্মদিন। আমি যখন নটর ডেম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সমসাময়িক লেখকের বই পড়া শুরু করি। সেই সময় প্রথম পরিচিত হই হুমায়ুন আহমেদের তিনটি বইয়ের সঙ্গে। ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এবং বিজ্ঞান কল্প কাহিনী ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। 

অসাধারণ লেগেছিল তার বই তিনটি। এই তিনটি উপন্যাস ও গল্প আমার অন্তরে স্থান করে নিয়েছিল। এরপর অনেকদিন তার কোনো গল্প-উপন্যাস পড়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভবত তৃতীয় বর্ষে আবার শুরু করি তার গল্প-উপন্যাস। তার অনেক গল্প-উপন্যাস পড়েছি কিন্তু প্রথম যে তিনটি বই আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল, পরবর্তী লেখায় তেমন প্রভাবান্বিত হইনি। তবে তার সৃষ্ট অসাধারণ চরিত্র হিমু এবং মিসির আলী আমার খুব ভালো লাগে। হুমায়ুন আহমেদ আবারও আমার প্রিয় হয়ে উঠলেন ছোট পর্দায় তার লেখা ও পরিচালনায় নাটকের মাধ্যমে। তার নাটকের সংলাপের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। আর সে কারণেই বোধ হয় বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপ প্রধান নতুন শৈলীরজনক।

আমরা যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, একই বছরে রসায়ন বিভাগের অনেক শিক্ষক চলে গিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে। রসায়ন বিভাগ শিক্ষক শূন্য হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আসতেন আমাদের ক্লাস নিতে। তখন আমার মনে আশা জেগেছিল হুমায়ুন আহমেদ স্যারও হয়ত আসবেন। কিন্তু আমার আশাপূরণ হয়নি। ছাত্রজীবনে তাকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে থাকলেও কোনোদিন দেখা করার সুযোগ হয়নি। দেখা করার বিশেষকারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তিনি তার এক গল্পে লিখেছেন, পিএইচডি করার সময় তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়েছিলেন এবং প্রথম পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। এটা কীভাবে সম্ভব! আমি তখন রসায়নশাস্ত্রে পড়ছিলাম এবং আমার একটি কোর্সে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল একটি বিষয়। অতি পারমাণবিক কণা অথবা তরঙ্গের মাপনীতে পদার্থের আচরণ বর্ণনা করে, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই সংজ্ঞায় আমার কোনো সংশয় ছিল না। কিন্তু এই মাপন পদ্ধতির জটিল সমীকরণ নিয়েই খাবি খাচ্ছিলাম। তাই আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার ১০০ শতাংশ নম্বর পাওয়া কি নিছক গল্প নাকি বাস্তব? সীমিত জ্ঞান দ্বারা অসীম জ্ঞানের একজন মেধাবীকে যাচাই করাও ধৃষ্টতা। তারপরও ইচ্ছে বলে কথা।

বায়াজিদ গালিব

অবশেষে আমার বিয়ের পর প্রথম তার দেখা পেয়েছিলাম একুশের বইমেলায়। তিনি ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। ভাবলাম এই তো সুযোগ আমি এবং আমার স্ত্রী লাইনে দাঁড়ালাম। সেই সময়ে শাওনকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখি চলছিল। আমি এবং আমার স্ত্রী দুটি বই তার সামনে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার ব্যাপারটা কি সত্যি? তিনি চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন, বললেন কোন ব্যাপার? আমি বললাম, আপনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। তিনি আশ্বস্ত হলেন, হয়ত ভেবেছিলেন আমি শাওন সম্পর্কিত প্রশ্ন করব। তিনি আমাকে বললেন, তুমি ফিজিক্স না কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলে? আমি বললাম, আমি রসায়নশাস্ত্রে মাস্টার্স করেছি। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কত পেয়েছ? এবার আমি বিব্রত। তিনি বললেন, আমি একজন শিক্ষক আমাকে বললে ক্ষতি কি? আমি আমার নম্বর বললাম, তিনি বললেন বাহ! বেশ ভালো নম্বর পেয়েছ তো? আমি বিস্মিত হয়েছিলাম মাত্র। তারপর তার বইতে তিনি লিখলেন, শিল্পী ও গালিবকে আমার শুভেচ্ছা। সেদিনই তার সাথে প্রথম ও শেষ দেখা। আজও আমি এবং আমার স্ত্রী সে কথা মাঝে মাঝে আলোচনা করি।

হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার সুন্দর একটি লেখা লিখেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। সেখানে হুমায়ুন আহমেদের অনেক প্রশংসা করেছিলেন। হুমায়ুন আহমদ ছিলেন সাহিত্যিক, গান বা কবিতা তিনি তেমন একটা লিখেননি। তবে যে কয়টি গান তিনি রচনা করেছেন তা পাঠক-শ্রোতার মন কেড়েছে, এ কথা সত্যি। তিনি ছিলেন সাহসী লেখক, তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা নিয়ে লিখতেন। তিনি তার নাটকের চরিত্র নির্দোষ বাকেরের ফাঁসির সিদ্ধান্তে লাখো লোকের মিছিল বের করার মতো ক্ষমতাধর নাট্যকার, তেমনি দেশের দুঃসময়ে ‘তুই রাজাকার’ কথাটি প্রথম উচ্চারণ করিয়েছিলেন টিয়া পাখির মাধ্যমে। এমন লেখকের অকাল প্রয়াণ বাংলা সাহিত্যরে জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। হুমায়ুন আহমেদ বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথা সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় লেখক বলে গণ্য করা হয়। তার অকাল প্রয়াণ হয়েছে। তার কাছে বাংলার মানুষের আরও অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সে প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারেননি, কারণ মরণব্যাধি ক্যান্সার তার জীবন কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু জনপ্রিয়তা কেড়ে নিতে পারেনি। বাংলার অগণিত পাঠকের মধ্যমণি হয়ে রইবেন তিনি চিরকাল। শুভ হোক আপনার জন্মদিন। প্রিয় লেখক আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আমরা আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি। আপনি স্বর্গবাসী হন সেই প্রার্থনা করি পরম করুণাময়ের কাছে।

....ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।

লেখক
বায়াজিদ গালিব
ক্যালগেরী, কানাডা