ইনাম আহমেদ স্মরণে টরন্টোতে আলোচনা ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী
কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র অভিনেতা ইনাম আহমেদের ১০১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আলোচনা ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় টরন্টো ফিল্ম ফোরামের আয়োজনে টরন্টোর ৩০০০ ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউয়ের মাল্টিকালচারাল ফিল্ম স্ক্রিনিং সেন্টারে এ উপলক্ষ্যে আলোচনা ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনি চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা ইনাম আহমেদ ১৯২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কুচাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বিজ্ঞাপন
অনুষ্ঠানের শুরুতে অভিনেতা ইনাম আহমেদ অভিনীত কয়েকটি চলচ্চিত্রের অংশ বিশেষ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা এনায়েত করিম বাবুল সম্পাদিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। ৫০ মিনিটের এ প্রামাণ্যচিত্রে ইনাম আহমেদ উপস্থিত দর্শকদের সামনে অনেকটা মূর্তিমান হয়ে ওঠেন। প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর পর ইনাম আহমেদের জীবন ও কর্ম নিয়ে মূল আলোচনা করেন মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যকার আকতার হোসেন, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী সুলতানা হায়দার, সাংবাদিক ও লেখক সুব্রত নন্দী ও চলচ্চিত্র লেখক ও সমালোচক ইকবাল করিম হাসনু।
বিজ্ঞাপন
অভিনেতা ইনাম আহমেদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কানাডা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি আমিন মিয়া, ব্যারিস্টার শামিম আরা, রাজনীতিবিদ মোহসীন ভূঁইয়া, সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর, আবৃত্তি শিল্পী হিমাদ্রী রায়, রাজনীতিবিদ ফায়জুল করিম, কবি রেজা অনিরুদ্ধ, টরন্টো বাংলা বইমেলার আহ্বায়ক সাদী আহমেদ, নাট্য অভিনেতা ম্যাক আজাদ, কবি জিন্না চৌধুরী, সংস্কৃতিসেবী এম এ কাদের মিলু, টরন্টো ফিল্ম ফোরামের কার্যনির্বাহী সদস্য শেখ শাহনওয়াজ, সামাজিক সংগঠক শিবু চৌধুরী ও নাট্য নির্দেশক সুব্রত পুরু।
স্মরণ অনুষ্ঠানে অভিনেতা ইনাম আহমেদ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন টরন্টো প্রবাসী ইনাম আহমেদের কন্যা গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নারী উন্নয়ন কর্মী আসমা আহমেদ মাসুদ ও ইনাম আহমেদের দৌহিত্র মাশরুর ইশরাক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরুর সময়ের কিছু অজানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন টরন্টো ফিল্ম ফোরামের সভাপতি এনায়েত করিম বাবুল। স্মরণ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন টরন্টো ফিল্ম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনিস রফিক।
উল্লেখ্য, মাত্র ৮ বছর বয়সে নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে ইনাম আহমেদের অভিনয় জীবন শুরু হয়। ১৯৩১ সালে ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’ দেখার পর তার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আগ্রহ জন্মে। তার বাবা তদানীন্তন পূর্ব বাংলার শিক্ষা পরিদর্শক ছিলেন। ইনাম আহমেদ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বাটা সু কোম্পানিতে কয়েক বছর চাকরি করেন।
১৯৪৩ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালিত ‘সমাধান’ নামে কলকাতার একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে অভিনয় জীবন শুরু হয়। রূপালী পর্দায় তখন তার নাম ছিল ‘অরুণ কুমার’।
১৯৫০ সালে ইনাম আহমেদ ঢাকায় চলে আসেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি তিনি ঢাকায় বেতার ও মঞ্চে অভিনয় এবং বেতারে সংবাদ পাঠ করতেন। নাটক করতে গিয়েই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনি চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’র পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯৫১ সালে ইনাম আহমেদ ‘রূপশ্রী’ নাট্যদলের সদস্য হিসেবে শংকরের লেখা ‘দুই পুরুষ’ নাটকে অভিনয় করেন এবং নাটকটি ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে মঞ্চস্থ হয়। ইনাম আহমেদ ওই নাটকে ‘কালী বাদশী’ চরিত্রে অভিনয় করেন। এ নাটকে তার অভিনয় দক্ষতা দেখে আব্দুল জব্বার খান তার নাট্যদল ‘কমলাপুর ড্রামা সার্কেল’র ‘মাটির মানুষ’ নাটকে ‘কালু সর্দার’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান। এ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি একজন শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৫২ সালে ‘কমলাপুর ড্রামা সার্কেল’ এর পরবর্তী নাটক ‘শমশের ডাকাত’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে তাকে মনোনীত করা হয়। কিন্তু নাটকটি মঞ্চস্থ হয়নি। ১৯৫৪ সালে নাটকটি নিয়ে আব্দুল জব্বার খান ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ শুরু করলে ইনাম আহমেদ এ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৫৬ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি লাভ করলে চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে ইনাম আহমেদ চলচ্চিত্র প্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এরপর ইনাম আহমেদ পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে যান উর্দু চলচ্চিত্র ‘আখেরি নিশান’-এ অভিনয় করার জন্য। পশ্চিম পাকিস্তানে থাকাকালে তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি করাচি বেতারে বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন। বাংলা ছাড়াও তিনি উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন।
তারপর ১৯৬১ সালে ‘যে নদী মরু পথে’ ছবিতে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে– হারানো দিন (১৯৬১), সূর্য ম্নান (১৯৬২), সোনার কাজল (১৯৬২), জোয়ার এলো (১৯৬২), নতুন সুর (১৯৬২), চান্দা (১৯৬২), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সুতরাং (১৯৬৪), দুই দিগন্ত (১৯৬৪), মিনার (১৯৬৫), রূপবান (১৯৬৫), ময়নামতি (১৯৬৮) প্রভৃতি।
তার অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে– নাচের পুতুল (১৯৭১), চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), শুভ দা (১৯৮৬), এখনও অনেক রাত (১৯৯৭), নিশান, গুনাহগার, আসামী হাজির, তুফান, পদ্মাবতী, নসীব, চন্দ্রনাথ, শিরী ফরহাদ, শুভ দা, গৃহ বিবাদ ইত্যাদি। ইনাম আহমেদ দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
একসময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘ঝিনুক’ এ তিনি ‘আমার শিল্পী জীবন’ শিরোনামে অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় একটি ধারাবাহিক লেখা বহু বছর লিখে গেছেন।
ইনাম আহমেদ ২০০৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার সাত সন্তানের মধ্যে এক ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ও আর্টিস্ট মারুফ আহমদ জার্মানিতে ও কন্যা গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আসমা আহমদ মাসুদ কানাডার টরন্টোতে বসবাস করছেন।
এসএসএইচ