ক্যালগেরিতে উপ-দূতাবাস চাই
শহরটি হু হু করে বাড়ছে। জনসংখ্যার বিচারে কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম শহর ক্যালগেরি। বাসস্থান, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা আর ট্যাক্সেশনের বিশেষ ছাড়ের কারণে শহরটি এখন অভিবাসীদের পছন্দের শীর্ষে। বাংলাদেশিদের পদচারণায় এ শহরটি এখন মুখরিত। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশি কমিউনিটির আয়োজন ও সরব উপস্থিতি দেখে মূলধারার রাজনীতিও আজ প্রভাবিত। তাই যেখানেই বাংলাদেশিদের আয়োজন, সেখানেই ফেডারেল আর প্রভিন্সিয়াল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এমপি, মন্ত্রীদের সরব উপস্থিতি।
জনসংখ্যা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও দক্ষতায় এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ।
বিজ্ঞাপন
একটি শহরে প্রায় ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশির বসবাস। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ক্যালগেরি, এডমন্টন আর আশপাশের ছোট ছোট শহরগুলোতে বসবাসকারী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকে হিসাব করলে সংখ্যাটি যে ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ও সাসকাচুয়ান প্রদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের যোগ করলে কানাডায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি জনগোষ্ঠী এই তিনটি প্রদেশে বসবাস করে। আর ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে আলবার্টা তিনটি প্রদেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। পেট্রো নগরী ক্যালগেরি এই প্রদেশটির বৃহত্তম শহর।
কানাডার অর্থনীতিতে আলবার্টা প্রভিন্স জাতীয় রাজস্বের অন্যতম বৃহত্তম যোগানদাতা। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এ প্রদেশটির বৃহত্তম শহর ক্যালগেরিতে উত্তর আমেরিকার সব কয়টি বড় অয়েল কোম্পানির সদর দপ্তর অবস্থিত। কানাডায় অভিবাসী বাংলাদেশি পেশাজীবীদের বৃহত্তম অংশটি এই শহরে বসবাস করে। ভূতাত্ত্বিক ও প্রকৌশলীদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সরকারি বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশিদের অবদান চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দক্ষ পেশাজীবীদের অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ক্যালগেরি শহরকে কেন্দ্র করে বাঙালি কমিউনিটির একটি শক্তিশালী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি হয়েছে। স্থানীয়, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী সেতুবন্ধন। গত ছয় মাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির চল্লিশটিরও বেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের এমপি, মন্ত্রীদের সরব উপস্থিতি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বিজ্ঞাপন
অটোয়া বাংলাদেশ মিশন ও টরন্টো কনস্যুলেট জেনারেলের কার্যালয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখভাল আর দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিস। দুটি কার্যালয়ের অবস্থানই অন্টারিও প্রদেশে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, আলবার্টা ও সাচকাচুয়ান প্রদেশ থেকে যার দূরত্ব যথাক্রমে ২৬৬৪, ১৯৯১, ১৪৬৮ কিলোমিটার। বিমান পথে সাড়ে তিন ঘণ্টা থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার পথ। কোনো সেবা গ্রহীতাকে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স থেকে অটোয়া বা টরন্টো গিয়ে সেবা গ্রহণ করতে হলে, ব্যক্তিগত খরচের অঙ্কটি দেড় থেকে দুই হাজার ডলারে দাঁড়ায়। তিন সদস্যের পরিবারের আনুমানিক খরচের অঙ্কটি প্রায় পাঁচ হাজার ডলারে পৌঁছে যায়। সেই সঙ্গে সময় আর শ্রমের বিষয়টি তো আছেই। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত কেউ সেবা গ্রহণের জন্য অটোয়া বা টরন্টোমুখী হতে চান না। ফলশ্রুতিতে ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সগুলোতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ নতুন পাসপোর্ট অথবা পুরাতন পাসপোর্ট নবায়ন না করে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন। অর্থ ও সময়ের সমন্বয় না করতে পেরে কানাডিয়ান ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নেন। যদিও বছরে বা দুই বছরে একবার দুই-তিন দিনের জন্য হাইকমিশনের কনস্যুলার সার্ভিস টিম বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে, তবুও চাহিদা ও সময় বিবেচনায় সেবা গ্রহণে আগ্রহী একটি বড় অংশ সেবা বঞ্চিত থেকে যায়। এসব বিশেষ ক্যাম্পিংয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারা নিরলস রাতদিন সেবা দিয়ে থাকেন, তবুও প্রত্যাশীদের একটি বড় অংশকে সেবা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
গত এক বছরে দুই পর্যায়ে মাত্র ছয় দিনে বাংলাদেশ হাই কমিশন ক্যালগেরি শহরে প্রায় দেড় হাজার আবেদনকারীকে সেবা দিয়েছেন। অনেক আবেদনকারী একাধিক সার্ভিস গ্রহণ করেছেন। মাথাপিছু গড়পড়তা ১২০ ডলার হিসাব করলেও ছয়দিনে রাজস্ব আহরণের মাত্রা দাঁড়ায় এক লাখ ৮০ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় কোটি টাকারও বেশি। এই চিত্রটি শুধু ক্যালগেরি শহরের হলেও সব কয়টি ওয়েস্টার্ন প্রদেশের অবস্থা একই রকম। দুই-তিন দিনের কনস্যুলার সার্ভিস ক্যাম্পিংয়ে দেখা দেয় উপচে পড়া ভিড়। সেবা গ্রহীতাদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে হাইকমিশন কর্মকর্তাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গলদঘর্ম হতে হয়। তবুও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অভিবাসী বাংলাদেশিদের একটি বৃহত্তম অংশকে সেবা গ্রহণ থেকে দূরেই থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে তিনটি ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, আলবার্টা ও সাসকাচুয়ানের মধ্যবর্তী স্থান ক্যালগেরি শহরে বাংলাদেশ সরকারের একটি উপ-দূতাবাস স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন থেকে যায় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় একটি উপ-দূতাবাস স্থাপন কতটা যুক্তিপূর্ণ হবে–
প্রথমত, অভিবাসী বাংলাদেশিদের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এই তিনটি প্রদেশে বসবাস করায় ড্রাইভিং দূরত্বে সেবা কেন্দ্র থাকলে অধিক সংখ্যক বাংলাদেশি সার্ভিস গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে, বৃদ্ধি পাবে রাজস্বের পরিমাণ।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশি কমিউনিটি সংগঠনগুলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে বাংলাদেশ দূতাবাসকে একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিনা ভাড়ায় প্রয়োজনীয় অফিস স্পেস দিতে আগ্রহী বিদায় বাংলাদেশ সরকারকে অন্তত কয়েক বছরের জন্য ভাড়া বাবদ বাড়তি অর্থের জোগান দিতে হবে না।
তৃতীয়ত, একদিকে প্রবাসীদের কল্যাণে সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি যেমন পরিস্ফুটিত হবে, অন্যদিকে এই তিনটি প্রদেশে বসবাসকারী একটি বৃহত্তম বাংলাদেশি পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দুটি দেশের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আরও সহজতর হয়ে উঠবে।
চতুর্থত, প্রবাসে বাংলাদেশের মিশনগুলো শিক্ষা, প্রযুক্তি, বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ নানা কূটনৈতিক স্বার্থ নিয়ে কাজ করে। প্রবাসে বাংলাদেশিদের একটি দক্ষ ও সংঘটিত কমিউনিটি এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। এসব বিবেচনায় নিঃসন্দেহে বলা যায়, ক্যালগেরির পেশাজীবী বাংলাদেশি কমিউনিটিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম সেক্টরে দেশের জন্য নানারকম সুবিধা সৃষ্টি সহজতর হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে সম্প্রসারিত হবে বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ। কানাডার মূলধারার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ক্যালগেরির বাংলাদেশি কমিউনিটির ঘনিষ্ঠ সংযোগ সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে ক্যালগেরি শহরে বাংলাদেশ সরকারের একটি উপ-দূতাবাস হতে পারে দুটো দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিনিময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন।
২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে কাজ করছে শেখ হাসিনার সরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ও নানা রকম বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে আরও অনেক দূরে এগিয়ে যেতে হবে। সব সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে তার নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বৈরিতা নয়, বন্ধুত্বের মাধ্যমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এই এগিয়ে যাওয়ার পথে ক্যালগেরি শহরে একটি উপ-দূতাবাস হতে পারে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ইতিহাসের আরেকটি মাইলফলক। তাই শুধু অভিবাসী বাংলাদেশিদের নিজ স্বার্থে নয়, তাদের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য উন্নয়নের সেতুবন্ধন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি উপ-দূতাবাস সৃষ্টির দাবি কানাডার ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সগুলোতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আকাঙ্ক্ষা পূরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুবিবেচনা প্রসূত সুদৃষ্টি, অভিবাসী বাংলাদেশিদের সাধারণ প্রত্যাশায় পরিণত হয়েছে। কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহানুভূতিশীল সদিচ্ছা নিশ্চয়ই সেই প্রত্যাশা পূরণের পথকে সুগম করে তুলবে।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : mahssan8691@gmail.com