সাম্যের ঈদ চাই
৫৫ বছরের জীবনে শতাধিক ঈদ অভিজ্ঞতায় আমি সমৃদ্ধ। মুসলিম উম্মাহর জীবনে ঈদ মানে আনন্দ। সম্প্রীতি আর ভালোবাসার মানুষগুলোকে নিয়ে ধর্মীয় ভাব-গম্ভীর পরিবেশে সুখী, দুঃখী, ধনী, গরিব নির্বিশেষে আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেওয়াই আমার কাছে ঈদ।
ঈদ সামনে রেখে আলাদা বাজেট হবে। মা, বাবা, ভাই, বোন আর স্বজনদের জন্য নতুন জামা কাপড় হবে। আমার শিক্ষার্থী জীবনটি দেখে যে ভূমিহীন দীনহীন প্রতিবেশী একদিন পুলকিত হতো, তার সাথেও ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি হবে। যে ভাইটি সুবেহ-সাদিকে লাঙল কাঁধে হালের বলদ নিয়ে মাঠে ছুটত, ঈদ সামনে রেখে তার মুখেও হাসি ফুটবে। যদি তাই না হয়, তবে সেটি আবার কীসের ঈদ? দেশে আজ দুরকম মানুষ। একদল টাকার পাহাড়ে ঘুমায়। আর একদল অর্থাভাবে কপাল চাপড়ায়। সমাজে কপাল চাপড়ানো মানুষরাই এখন সংখ্যাধিক্য। এরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা হয়ে নীরবে চোখের জল ফেলে। এ মানুষগুলোর চোখের জলের সঙ্গী না হতে পারলে সাম্যের ঈদ কোথায়?
বিজ্ঞাপন
স্থান-কালভেদে ঈদ আনন্দের ব্যারোমিটার ওঠানামা করে। শৈশবের ঈদ আনন্দ যৌবনে খুঁজে পাইনি। বিবাহিত জীবনে ঈদ যেন কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। বউ চায় শ্বশুর বাড়িতে ঈদ করি। আমি চাই ভালোবাসার শৈশবের মাটিতে ফিরে যাই। এই দ্বন্দ্ব সংঘাতে ঈদ আনন্দ তেতো হয়ে যায়। যখন সন্তানের পিতা হই, অনুভূতি ভিন্ন বৈচিত্র্যে রূপ নেয়। আমি চাই, সন্তান আমার প্রিয় মাটিতে প্রিয়জনদের সাথে হেসে খেলে ঈদকে বরণ করবে। স্ত্রী চায়, ঈদ হোক তার প্রিয়জনদের সাথে। শুরু হয় ভাগাভাগি। একবার এদিকে তো অন্যবার সেদিকে। গ্রামে জন্ম, গ্রামের মাটি না ছুঁলে আমি ঈদ খুঁজে পাই না। নগরের ঈদকে আমার বড় বেশি মেকি মনে হয়। তবুও দাম্পত্য জীবনকে সম্মান জানাতে এমন কিছু মেকি ঈদও আমার জীবনে এসেছিল। নতুন জামা কাপড়ে বাহ্যিক চাকচিক্য আর মুখে কৃত্রিম হাসির ছোঁয়া থাকলেও এসব দিনে কখনো মনের ঈদ হয়ে ওঠেনি।
আজ আঠারো বছর পাশ্চাত্যে থাকি। এখানকার ঈদকে কোনোভাবেই দেশ মাতৃকার ঈদের সঙ্গে তুলনার সুযোগ নেই। এখানে কর্মীর কোনো ঈদ বোনাস নেই, গণছুটি নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ কর্মদিবসের ব্যত্যয় ঘটে না। দৈব চক্রে ঈদটা যদি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হয় আমেজটা হয় ভিন্ন রকম। আর কর্মদিবসে ঈদ হলে বিশেষ অনুমতিতে ছুটি নিতে হয়। অনেকে সেই সুযোগটি গ্রহণ করে, আবার কেউবা মনোবেদনাকে সঙ্গী করে কাজে চলে যায়। তবুও ঈদকে জাগিয়ে রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চলে।
বিজ্ঞাপন
শহরজুড়ে বড় বড় ঈদের জামাত হয়। সকাল থেকে নগরের চিত্র পাল্টে যায়। পায়জামা, পাঞ্জাবির মানুষে শহরটি বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। দিনভর বাহারি খানাপিনার আয়োজনে ভোজন রসিক বাঙালিদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সন্ধান মেলে। তবুও সব আয়োজনকে আমার মেকি মনে হয়। হাসিমুখে কোলাকুলি হলেও হৃদয়ের ভালোবাসাটি জেগে ওঠে না। সুখে পাশে থাকলেও দুঃখে পাশে থাকার লোকের বড়ই আকাল। তাই সব আয়োজন যেন দুঃখকে পেছনে ঠেলে বেঁচে থাকার এক নিরন্তর প্রচেষ্টা। মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব প্রচেষ্টার সঙ্গী হতে হয়।
গত কয়েক বছর ধরে মানুষের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য নেই। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস। একদিকে ট্যাক্সের চাপে জীবন দিশেহারা, অন্যদিকে মর্টগেজের বাড়াবাড়ি। ক্রমবর্ধমান সুদের হার আর ট্যাক্সের আয় দিয়ে সরকার চলে। ঈদ সামনে রেখে দেশে থাকা আপনজন প্রবাসীর দিকে চেয়ে থাকে। প্রবাসী তার দৈনন্দিন খরচ আর পরের মাসের মর্টগেজ নিয়ে দিশেহারা। তাই প্রবাসীদের জীবনে ঈদগুলো এখন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে ক্রমান্বয়ে সেটি আরও বিবর্ণ হচ্ছে। কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় আনন্দ আয়োজন হলেও মনের ঈদ এখন বহুদূর। এমন পরিস্থিতিতেই ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল ঈদুল আজহা সমাগত।
মানব ইতিহাসের বর্বরোচিত অধ্যায়ে পবিত্র নগরী জেরুজালেম। গাঁজার ভূখণ্ডে মৃত্যুর আর্তনাদ। মানবতার জয়গান গাওয়া বিশ্ব মোড়লের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিনিয়ত ঘটছে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মানবিক বিপর্যয়। তাদের এই চরম বিপর্যয়ের দিনেও প্রতিবেশী মুসলিম মোড়লেরা জেগে ওঠে ঈদ আনন্দে। আমার কাছে সেই ঈদকেও মেকি মনে হয়। বাইরে কৃত্রিম হাসি, হৃদয়ে চাপা কষ্ট। না, এমন ঈদ আর চাই না। সাম্যের ঈদ চাই, ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল ভালোবাসার ঈদ চাই। শৈশবের সেই ঈদকে আবারও ফিরে পেতে চাই।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : mahssan8691@gmail.com