পর্তুগালের কৃষি অধ্যুষিত অঞ্চল অদিমেরা সম্প্রতি করোনার অধিক সংক্রমণের কারণে পর্তুগিজ সরকারের নজরদারিতে আসে। এরপর কয়েকটি সংস্থার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বিভিন্ন কোম্পানির অনিয়ম এবং কৃষি শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের অন্যায় আচরণের নানা চিত্র।

দেশটির রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে পর্তুগিজ সংবাদমাধ্যমে এই অঞ্চলকে নিয়ে বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলা নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।

অভিবাসীবান্ধব দেশ পর্তুগালের কর্তাব্যক্তিরা কোনোভাবেই অভিবাসীদের প্রতি অনিয়ম মেনে নিতে পারছেন না। তারা অদিমেরার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পর্তুগালের অন্যতম রাজনৈতিক দল বাম ব্লকের (ব্লক এস্কেরদা) প্রধান কাতারিনা মারটিনস পর্তুগিজ সরকারের আন্ত প্রশাসন মন্ত্রী এদোয়ারদো কাব্রিতার পদত্যাগ দাবি করেছেন। এভাবে একজন মন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার দাবি পর্তুগালের ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায় না।

সম্প্রতি অদিমেরায় যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো- ওই অঞ্চলে বসবাস করা কৃষি শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এবং আবাসন অব্যবস্থাপনা অর্থাৎ কৃষি শ্রমিকরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কর্মক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে।

অভিবাসীদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বেশকিছু দুর্নীতির চিত্রও উঠে এসেছে যেমন- বিভিন্ন ব্যক্তি কোম্পানি খুলে বাস্তবে কোনো কর্মকাণ্ড না থাকলেও শত শত কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। তাছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও সেই কোম্পানিতে রয়েছে একশরও বেশি কর্মচারী। সেই সঙ্গে মজুরির তারতম্য তো রয়েছেই।

এ ধরনের কোম্পানি বিপুল পরিমাণ সরকারের কর এবং সোশ্যাল সিকিউরিটির পাওনা বকেয়া রেখে কোম্পানির মালিক নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন বা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অন্য নামে স্থানান্তর করে কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণা করে দেশ ত্যাগ করেছেন।

এ ধরনের অনেক কোম্পানি তাদের কর্মকাণ্ড চালায় নগদ অর্থে, যা পর্তুগাল এবং ইউরোপের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি বিপরীত চিত্র অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কখনোই একটি গাড়ি, বাড়ি এমনকি শত শত শ্রমিকদের মজুরি নগদ অর্থে প্রদান করেছে, যা প্রশাসনের চোখে দুর্নীতির এবং মানবপাচারের সন্দেহ তৈরি করেছে। যেহেতু শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, তাই বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থের বিষয়টি মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে।

এই অঞ্চলে পর্তুগালের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ব্যবসা বা শ্রমজীবী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছেন অথবা কৃষি শ্রমিক হিসেবে বছরের প্রায় সাত থেকে আট মাস কাজ করছেন। অদিমেরা অঞ্চলে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও এমন তথ্য দিয়েছেন। অদিমেরায় ৬ বছর ধরে বসবাস করছেন শাফায়াত হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে প্রথম যখন এসেছি, তখন খুব সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতাম। স্থানীয় পর্তুগিজ নাগরিকরা অনেক সহযোগিতা করেছে। কিন্তু হঠাৎ করে ২০১৭ সালের পর থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের অভিবাসীদের আগমন এবং তাদের বিরূপ কর্মকাণ্ডের কারণে আমরা স্থানীয় নাগরিক এবং প্রশাসনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছি। এর দায় সামান্য কিছু বাংলাদেশি ও দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের অভিবাসীদের।

পর্তুগালের ভেজা জেলাটি ১৪টি থানা নিয়ে গঠিত। পুরো অঞ্চলটি কৃষি কাজের জন্য বিখ্যাত। এর মধ্যে অদিমেরা হচ্ছে উপকূলবর্তী একটি অঞ্চল। কৃষি কাজের ছাড়াও পর্যটনের জন্য প্রসিদ্ধ এটি। অপ্রতুল জনগণের দেশ পর্তুগালে ওই অঞ্চলটিতে জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে, যা করোনা মহামারিতে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে পর্তুগিজ প্রশাসন অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে। পর্তুগাল সরকার এই অঞ্চলের কৃষি কাজে নিয়োজিত অভিবাসী এবং দেশের অভিবাসন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে আরও বেশি নজরদারি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। যার ফলে সুষ্ঠু উপায়ে যেসব অভিবাসী পর্তুগালে বসবাস করছেন, তাদের অধিকারগুলো খুব সহজেই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। অপরদিকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা অভিবাসীদের জন্য দেশের দরজা খুলে রেখেছেন। কেননা, পর্তুগালের কর্মক্ষেত্র অনুযায়ী দক্ষ কর্মীর সংখ্যা কম।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পর্তুগিজ রাষ্ট্রপতি মার্সেলো রেবেলো ডি সজা বলেন, আমাদের অভিবাসী প্রয়োজন। অবশ্যই তাদের প্রাপ্য পূর্ণ মর্যাদা দিতে হবে। 

প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টোনিও কস্তাও কৃষি শ্রমিকদের আবাসন কাজের পরিবেশসহ বিভিন্ন সময়ে অভিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তাছাড়া বর্তমান ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টি ক্ষমতার বিভিন্ন মেয়াদে পর্তুগালের অভিবাসীদের স্বাগত জানানোসহ তাদের সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। 

পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী যে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন, এই সমস্যাটি এক দশক ধরে চলে আসছিল। তবে এটি এতদিন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে এবং ইতোমধ্যে বেশকিছু ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।

এসএসএইচ