বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীদের তালিকায় বাংলাদেশি নওশাদ আমিন
ডানে প্রফেসর ড. নওশাদ আমিন
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশি প্রফেসর ড. নওশাদ আমিন। সম্প্রতি তালিকাটি প্রকাশ করা হয়।
ফলিত পদার্থ বিদ্যায় মালয়েশিয়ার ১১ জন বিজ্ঞানী এ তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রফেসর নওশাদ আমিনও রয়েছেন। তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি তেনাগা ন্যাশনালের অধ্যাপক।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপানে পাড়ি জমান প্রফেসর নওশাদ। আমেরিকা ও ব্রিটেনেও কিছুদিন গবেষণা করেছেন।
বর্তমানে মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ার পাশেই বাঙ্গি শহরে মা দিলারা আমিন, স্ত্রী জান্নাতুল ওয়াসুল ও তিন কন্যাকে (নুসাইবা, যাহরা ও আয়েশা) নিয়ে থাকেন ড. নওশাদ।
বিজ্ঞাপন
প্রফেসর নওশাদ আমিন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা গ্রামের চিকিৎসক নুরুল আমিন চৌধুরী ও দিলারা আমিনের দ্বিতীয় সন্তান। জন্ম থেকেই চট্টগ্রাম শহরের নন্দন কাননের নানা বাড়িতেই বেড়ে ওঠা। বাবা (প্রয়াত) চিকিৎসক নুরুল আমিন চৌধুরী স্বাধীনতা উত্তরকালে কর্ণফুলী পেপার মিলের হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গেও। যুদ্ধের সময় আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন। ফলে পেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও।
নওশাদ আমিন চট্টগ্রামের নন্দন কানন এলাকার পাহাড়িকা কিন্ডার গার্টেন থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বছর দুই চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়েছিলেন। পরে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করেন। তৎকালীন কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে ষষ্ঠ (১৯৮৭) এবং উচ্চ মাধ্যমিকে একই বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম (১৯৮৯) স্থান লাভ করেন।
এরপর ভারত এবং জাপান সরকারের পূর্ণ বৃত্তি ও আমেরিকাতে আংশিক বৃত্তি লাভ করেন। তবে বাবার ইচ্ছেতেই জাপানের মনবুশো (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) বৃত্তি গ্রহণ করে ১৯৯০ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪ বছর জাপানেই কাটান। জাপানী ভাষা শেখার পর তড়িৎ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা (১৯৯৪, গুনমা কলেজ অব টেকনোলজি), স্নাতক (১৯৯৬, তোয়োহাসি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি) এবং টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে মাস্টার্স (১৯৯৮) এবং পিএইচডি (২০০১) অর্জন করেন।
এরপর বছর তিনেক জাপান মটোরোলাতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাঝে বছরখানেকের জন্য আমেরিকার সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতে ফেলোশিপে ও গবেষণা করেন। স্নাতক পর্যায় (১৯৯৬) থেকেই সৌর বিদ্যুতের মূল সৌরকোষ বিষয়ে গবেষণা শুরু। তবে ২০০৪ সালে মালয়েশিয়ার মাল্টিমিডিয়া ভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
তবে গবেষণার পরিবেশ না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ ছিলেন। এরপর ২০০৬ এ মালয়েশিয়ার সরকারি ‘ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়া’ এ সিনিয়র লেকচারার পদে যোগ দিয়ে ২০০৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০১২ থেকে প্রফেসর পদে পদোন্নতি পান। গবেষণাগার তৈরি থেকে শুরু করে সৌরকোষের গবেষণার কাজ শুরু হয় এখানেই।
এরপর মালয়েশিয়া ছাড়াও সৌদি আরব, কাতার ফাউন্ডেশনের গবেষণার নানা অনুদান লাভ করে কাজকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেন। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ১০ বছর ধরে চলছে তার গবেষণার কাজ। তৈরি হয়েছে অনেক দক্ষতা-সম্পন্ন ছাত্রছাত্রী ও অনুরাগী গবেষক। এরপর ২০১৮ থেকে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি তেনাগা ন্যাশনালের বিশেষ আমন্ত্রণে ‘স্ট্রাটেজিক হায়ার প্রফেসর’ হিসেবে যোগ দেন।
সৌরবিদ্যুতের প্রাণকেন্দ্র সৌরকোষের ওপর তার গবেষণার কাজ মূলত দু’প্রকারের- মৌলিক/ফান্ডামেন্টাল এবং ফলিত/অ্যাপ্লায়েড। এরই মধ্যে মালয়েশিয়ার পাওয়ার কোম্পানির ৫০ কোটি টাকা সমমানের অনুদানে গবেষণাগার তৈরির দায়িত্ব পড়ে তার ওপর, যা চলতি মাসে (ডিসেম্বর) শেষ হবে।
এছাড়াও এ বছরই আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের যৌথ অনুদান লাভ করেন।
বাংলাদেশে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা অনুদান ‘হেক্যাপ’ লাভে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন তিনি। পরে প্রধান পরামর্শক হিসেবে গবেষণাগার তৈরি ও সৌরকোষ গবেষণার কাজে এখনও সহায়তা করে যাচ্ছেন। এছাড়া সায়েন্স ল্যাবরেটরির জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্রে দ্বিতীয় প্রজন্মের সৌরকোষ গবেষণার উদ্যোগ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা করে আন্তর্জাতিকমানের গবেষণাগার স্থাপনায় পরামর্শক ও প্রাথমিক প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন।
সর্বোপরি, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সময়ে সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদিতে অংশ নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্প্রসারণের উপর সর্বদা গুরুত্ব দিয়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।
নওশাদ আমিন জানান, ১০-১৫ বছর আগেও গবেষণা বিষয়ে বাংলাদেশ বা মালয়েশিয়ার মধ্যে কোনো বিশেষ পার্থক্য ছিল না। শুধু নেতৃত্বের সদিচ্ছার কারণে মালয়েশিয়া আজ অনেক এগিয়ে গেছে
সৌরশক্তির সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে দুর্নীতি ও নেতিবাচক প্রচারের কারণে সৌরশক্তির সম্ভাবনাময় গ্রহণযোগ্যতা দেখতে পারছে না। বিশ্বে এ পর্যন্ত ৬০০ গিগাওয়াটের সৌরশক্তির স্থাপনা হয়েছে, যা কি না সহজ ভাষায় ৪৫০টির ও অধিক এক গিগাওয়াট (১ এড) মানের পারমাণবিক চুল্লিকে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম।’
‘সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গেই সোলার প্যানেল সারা বিশ্বের কোনো না কোনো জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে এগিয়ে আছে চীন, জাপান, জার্মানি, স্পেন, আমেরিকা, ভারত এবং আরও অনেক দেশ। গেল বছর পর্যন্ত বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। দুর্বল নীতিমালাই মূল কারণ। ২০২০ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুতের ১০ শতাংশ আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে যার মূলে থাকবে সৌর কোষ/প্যানেল, বাংলাদেশ সরকারের সে রকমই পরিকল্পনা। দুর্বল আমদানি ও পরীক্ষণ নীতিমালার কারণে উচ্ছিষ্টমানের সৌর প্যানেল আমদানি করে ইতোমধ্যেই জনমনে নেতিবাচক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। বিশ্ব আর বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে ভেবে অনুসন্ধান করে দেখবেন, স্ফটিক-এর মতো স্বচ্ছ হয়ে আসবে সব।’
‘বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের ভবিষ্যৎ নেই’ এমন প্রচলিত ধারণার প্রেক্ষিতে প্রফেসর নওশাদ আমিন বলেন, ‘আগে বিশ্বাস করতে হবে বিশ্বের সব সফল দেশগুলোর উদাহরণ থেকে, যারা দিনে আমাদের চেয়ে অর্ধেক মাত্র সূর্যালোক পায়। তারপরে যেসব দেশ শুধু সোলার কেই তাদের উন্নয়নের রোডম্যাপে প্রাধান্য দিয়ে এগোচ্ছে, তাদের অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা খুবই দুর্বল নীতিমালায় আক্রান্ত, শিক্ষা-গবেষণা ও বাণিজ্যিক প্রসারে। দেশের যে কোম্পানিগুলো সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, তাদের উৎসাহিত তো করাই হয়নি, দুর্বল অপরীক্ষিত আমদানি নীতিমালার কারণে অধিকাংশই ধসে পড়েছে বিদেশি নামহীন কোম্পানিগুলোর কাছে পরাজিত হয়ে।’
এফআর