বিশ্বায়নের এ যুগে দেশের খ্যাতি ও সুনামকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে জোরেশোরে দেশকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। ব্র্যান্ডিংয়ের মানে হচ্ছে দেশের আলোকিত দিকগুলো বিশ্বের কাছে তুলে ধরা। শনিবার (২৩ অক্টোবর) একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন মালয়েশিয়ার সানওয়ে ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়।

মালয়েশিয়ায় মেধা ও প্রজ্ঞায় যারা নিজ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন তাদের একজন সানওয়ে ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান। তিনি মেকানিকাল সাইন্টিস্ট হিসেবে বিশ্বের ৪৯তম এবং এনার্জিতে ৫০তম স্থান দখল করেছেন। এছাড়া বিশ্বসেরা গবেষকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন অধ্যাপক সাঈদুর। ল্যাঙ্কাস্টার জরিপে ২০২০ সালের সেরা চার জন গবেষকের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানেও স্থান পেয়েছেন তিনি।

দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে সাইদুর রহমান বলেন, দেশের ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং দাঁড় করাতে পারলে দেশের জনশক্তি, পর্যটন, দেশে তৈরি পণ্য, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সেবাও মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়। এখন বিশ্বের বিভিন্ন শহরেরও একটি ব্র্যান্ডিং ইমেজ রয়েছে। সেই ইমেজ দেখেই মানুষ ঠিক করে কোন শহরে বেড়াতে যাবে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই ব্র্যান্ডিংকে গুরুত্ব দিচ্ছে। রেডিও, টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপনে তা উঠে আসছে। যেমন মালয়েশিয়া ‘ট্রুলি এশিয়া’, ভারত ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’, চীন সারা বিশ্বের ‘কারখানা’ এবং শ্রীলঙ্কা ‘রিফ্রেশিংলি শ্রীলঙ্কা’ হিসেবে পরিচিত। এছাড়া থাইল্যান্ড নিজেকে তুলে ধরছে ‘অ্যামেজিং থাইল্যান্ড’ নামে। ইত্যাদি ইত্যাদি নামে চলছে বিভিন্ন দেশের ইতিবাচক প্রচারণা।

তিনি মনে করেন, উপযুক্ত ব্রান্ডিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের ইমেজ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব কিছু নয়। কেননা, আমাদের দেশে মেধার অভাব নেই। পোশাক শিল্পের পর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের চমকপ্রদ অগ্রগতি হয়েছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশেরও বেশি এবং বিশ্বের ১৬০টি দেশে বাংলাদেশ এখন ওষুধ রফতানি করছে।

অধ্যাপক সাইদুর বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ও বেক্সিমকো সম্প্রতি আমেরিকার বাজারে প্রবেশের অনুমোদন পেয়েছে। ওষুধ শিল্পের ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। পাটকে বলা হয় সোনালী আঁশ। এক সময় সোনালী আঁশের দেশ বলতে বাংলাদেশকেই চিনত সারাবিশ্ব। মেধা ও যুগোপযোগী প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে পাটকে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

তার মতে, বাংলাদেশের একটি গ্রহণযোগ্য ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে প্রয়োজন ঐক্যমত। এজন্য সরকার, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, দেশ ও প্রবাসের বাসিন্দা সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। যারা দেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করতে পারেন। বিশ্বের জনশক্তির বাজারে শুধু শ্রমিক রফতানির কথা না ভেবে দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের ইমেজ বদলে যাবে। সমস্যা আমাদের আছে ঠিকই, কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হলে নেতিবাচক দিকগুলো পেছনে রেখে বিশ্বের কাছে দেশকে নিয়ে একটি সুন্দর বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। যা বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বদলে দেবে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণায় পুরস্কারও পেয়েছেন অধ্যাপক সাঈদুর রহমান। তিনি ল্যাঙ্কাস্টারের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শক্তি প্রযুক্তি বিভাগ ও মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানোম্যাটরিয়ালস অ্যান্ড এনার্জি টেকনোলজির অধ্যাপক। তার কাজের মধ্যে ল্যাঙ্কাস্টারের এনার্জি রিসার্চ গ্রুপের নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য ন্যানোম্যাটরিয়ালের গবেষণা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিশ্বের পাঁচ শতাধিক জার্নাল তার গবেষণা প্রকাশ করেছে।

তার গবেষণাপত্র বিশ্বের অন্য গবেষকদের কাছেও সমাদৃত। তার গবেষণা কাজগুলোকে ৪৫ হাজারেরও বেশি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। ওয়েব অব সাইন্স ন্যানোফ্লুয়েড গবেষণায় তিনি প্রথম স্থানে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্বের সেরা গবেষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক সাইদুর রহমান বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের উদ্দেশে বলেন, আমার গবেষণার অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে প্রস্তুত আছি। সবাই মিলে বাংলাদেশকে বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হব। তিনি নিজ মেধা বাংলাদেশে কাজে লাগাতে প্রস্তুত আছেন বলেও জানান।

সাইদুর রহমান বলেন, একটা সময় ছিল দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনত, এরপর কায়িক পরিশ্রম করা কর্মীদের দেখছে বিশ্ব। এর সঙ্গে সঙ্গে যে মেধার ও কৃতিত্বের বিস্ফোরণ দেখাচ্ছে বাংলার মেধাবী সন্তানরা সেসব প্রকাশ পাচ্ছে এখন। এ যেন সেই একাত্তর সালের স্বাধীনতা অর্জনের মতোই। যার যা আছে তা নিয়ে লড়াই করে বিশ্বের বুকে কৃতিত্ব দেখিয়েছে।

মালয়েশিয়ায় কর্মরত এ অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে গবেষণা সহযোগিতা হতে পারে। বাংলাদেশি গবেষকদের জন্য অনলাইন গবেষণা সেমিনার সময়ে সময়ে আয়োজন করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, এনার্জি এখন বিশ্বের অন্যতম অনুষঙ্গ, উন্নয়নের বা ভোগের অন্যতম চালিকা শক্তি। অল্প বিনিয়োগে অধিক এনার্জি উৎপাদন, টেকসই উন্নয়নে গবেষণা এবং এর প্রয়োগের বিকল্প নেই।

এসএসএইচ