বিস্ময় আর মুগ্ধতার শহর জুরিখ
মাসখানেক হলো ভাবছি, ডেনমার্ক বা সুইজারল্যান্ড যাবো। কিন্তু ব্যস্ততার ফাঁকে সে সময়টুকু মিলছিল না। হঠাৎ সিদ্ধান্তে ব্রেমেন থেকে স্থানীয় সময় বুধবার রাত ৯টায় রওনা হলাম জুরিখের উদ্দেশ্যে।
তবে যাওয়ার কথা ছিল সুইসের সম্মেলেনের শহর জেনেভায়। কিন্তু অবশেষে প্রেম-প্রীতি নীলিমার শহরটিকে বেছে নিলাম। সুইজারল্যান্ডের স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় সুইস সীমান্তে প্রবেশ করলাম। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ট্রেনে যাওয়ার সময় সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে কোনো কিছু যাচাই করেনি সুইস পুলিশ বা ইমিগ্রেশন।
বিজ্ঞাপন
আমি পাসপোর্ট, রেসিডেন্স কার্ড, করোনা সার্টিফিকেট সবই সাথে রেখেছিলাম। কিন্তু কোনো কিছুই দেখাতে হয়নি। সাথে আমার ভ্রমণ সারথী আসাদ আলী জিকুরও।
আমাদের ট্রেন ছুটে চলছে জুরিখের দিকে। ব্লুমবার্গের মতে পৃথিবীর চতুর্থ ব্যয়বহুল শহর সুইজারল্যান্ডের জুরিখে প্রবেশ করেই কেমন জানি একটি অন্যরকম অনুভূতি খুঁজে পাই। সুন্দর এই দেশটি দেখার খুব শখ ছিল। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সৌন্দর্যময় দেশ সুইজারল্যান্ড। সত্যিই সুইসের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইউরোপ তথা পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে হার মানায়।
বিজ্ঞাপন
সুইজারল্যান্ডে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের ট্রেন, ট্রাম, বাস রয়েছে; যেগুলো দেশের এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এমনকি এই দেশের প্রধান প্রধান শহর থেকে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ সহজতর।
সুইজারল্যান্ডকে বলা হয় ইউরোপের হৃৎপিণ্ড। সুইজারল্যান্ডের উত্তরে জার্মানি, দক্ষিণে ইতালি, পূর্বে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে ফ্রান্স, উত্তর-পশ্চিমে লন্ডন, দক্ষিণ-পশ্চিমে স্পেনের বার্সেলোনা শহর অবস্থিত। অনেকের সাথে কথা বলে গুগল দেখে বুঝলাম সুইজারল্যান্ডকে কেন্দ্র করে ইউরোপ ভ্রমণ খুব সহজ। আমরা সারাদিন ঘোরার জন্য ট্রেন স্টেশন থেকে টিকেট কেটে নিলাম।
সুইসের ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের পরামর্শে প্রথমে রওনা দিলাম টপ অব জুরিখে। টপ অব জুরিখ থেকে যে দৃশ্য দেখা যায় তা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এরপরে ছুটে গেলাম জুরিখ লেকে। সেখান থেকে জুরিখ রেলস্টেশনে। এ স্টেশন দেখে মনে হয়েছে যেন বিমানবন্দর। এ স্টেশন থেকে শতাধিক ট্রেন ইউরোপের নানা গন্তব্যের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। চারতলা বিশিষ্ট এই রেলস্টেশন দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে।
জুরিখ থেকে দু-এক ঘণ্টার মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজধানী ও প্রধান শহরগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব। সারাদিন জুরিখের নানা জায়গা ঘুরে ছুটে গেলাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত বাকী উল্লা খান ভাইয়ের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। ফোনে অনেকবার কথা বলেছি বাকী ভাই ও সুইস পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশনের জন্য নির্বাচিত হওয়া সুলতানা খান আপার সাথে। আমি জুরিখে আছি,সেটা শুনে আপা বলে রাখলেন সারাদিন ঘুরে যেন তাদের আমদাম শপে খেতে যায়। আপার কথা রাখতে সেখানে যাওয়া। আমদাম শপের পাশে অস্থায়ী শহীদ মিনার, বাংলাদেশের পতাকা যে কাউকে ভাবিত করবে। বাকী উল্লা খান ও সুলতানা খান দম্পতি জুরিখে গড়ে তুলেছে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নমুনা। সুলতানা খানের ইচ্ছা সুইজারল্যান্ডে একটি স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ করা।
সেদিন রাতেই জার্মানির উদ্দেশে ট্রেনে রওনা হবো। স্টেশনে গিয়ে আমি আর জিকু ভাই একটি কফিশপে গেলাম। কফি কিনে টাকা দিতে গেলে দোকানি বললেন, কফির দাম দিতে হবে না, বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম, কেন? আমরা মূল্য দিয়েই কফি খেতে চায়। দোকানি বললেন, আমি মালিক। আমি আপনাদের কফি খাওয়াতে চায়, কফির দাম দিতে হবে না। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে চাইলেন আমাদের দেশ কোথায়। আমরা বললাম বাংলাদেশ।
এ শুনে তিনি বললেন, তার একসময়ের বাংলাদেশি সহকর্মী মামুনের কথা। গল্পের ঝাঁপি খুলে মামুনের প্রশংসা করে বললেন, তিনি খুব পরিশ্রমী ছিলেন, ছিলেন নিষ্ঠাবান একজন মানুষ।
ভিনদেশি এক দোকানির হৃদয়ে এভাবে এক বাংলাদেশির জায়গা করে নেওয়াটা আমাকে অনেকটা বিস্মিত করেছে। অচেনা মামুন যেন ভেনেজুয়েলার এই নারীর কাছে পুরো বাংলাদেশ।
নান্দনিক জুরিখের রূপ পরখ করে কফির চুমুকে চুমুকে ট্রেনের অপেক্ষায় আছি, গন্তব্য এবার জার্মানি। চোখধাঁধানো সুইজারল্যান্ড সত্যিই আমাকে মোহিত করেছে।
এনএফ