দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর একটি অংশ প্রবাসে জীবিকার কঠোর সংগ্রামে, সমস্যার ভারে ক্লান্ত। তারপরও কালপরিক্রমায় পুরোনো বছরের গ্লানি মুছে বছরের নতুন আশায় স্বপ্ন দেখছেন তারা, দাবি জানিয়েছেন সামাজিক সুরক্ষার।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার ডেল্টা ও ভ্যারিয়েন্টে টালমাটাল গোটা বিশ্ব। করোনা উত্তরণে দুই বছর ধরে বিশ্বজুড়ে চলছে প্রাণপণ চেষ্টা।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পর্যটনখ্যাত দেশ মালয়েশিয়াও ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার তার নাগরিকদের পাশাপাশি দেশটিতে বসবাসরত বিদেশিদের সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে।

দেশটির ১৩টি প্রদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছেন রেমিট্যান্সযোদ্ধারা। মহামারি সময়ে নাগকিদের পাশাপাশি রেমিট্যান্সযোদ্ধারাও সম্মুখ সারিতে থেকে সংকট উত্তরণে কাজ করে চলেছেন তারা।

কুয়ালালামপুরের টুইন টাওয়ার, এম আরটি, তুনরাজ্জাক একচেঞ্জ, কেএল টাওয়ার, মারদেকা টাওয়ার, সানওয়ে পিরামিড, সাইবার জায়া, পোর্টক্লাং, পেনাংয়ের বাতুফিরিঙ্গি সৈকত, তেরেঙ্গানুর মসজিদ, মেলাকার মালয় রেস্তোরাঁ, পাহাংয়ের চা বাগান, পেরাকের রাবার বাগান, লংকাউই দ্বীপ-কোথায় নেই বাংলাদেশিরা? জীবিকা নির্বাহের তাগিদে বাংলাদেশিরা মালয়েশিয়ায় বসবাস করলেও তাদের ঘাম ও পরিশ্রমের সুফল বেশ ভালোভাবেই নিচ্ছে ভারত মহাসাগর বুকের দেশ মালয়েশিয়া।

এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়ায় এসে আবার কেউ ফেরত গেছেন- এমন ঘটনা বিরল। বাংলাদেশিরাও খুব কম সময়েই মালয় ভাষা ও সংস্কৃতি আয়ত্ত করেছেন, গড়ছেন দেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ।

এতসব ভালো খবরের মধ্যেও মাঝে মধ্যে কিছু খবর পীড়া দেয়। সেখানে অবস্থানের কাগজপত্রের বিষয়ে অসতর্কতা বা খানিক ভুলে কিছু লোককে হয়রানি এমনকি শাস্তির মুখেও পড়তে হয়। আবার কিছু অসাধু চক্রের অসৎ কর্মের কারণে পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটিকেই অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়।

সচেতন মহলের মতে, সচেতনতা না থাকায় বাংলাদেশিদের বারবার এসব অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে হচ্ছে প্রবাসীদের।

‘জাতির পিতা, সুবর্ণে স্বাধীনতা, অভিবাসনে আনব মর্যাদা ও নৈতিকতা’ স্লোগানকে সামনে রেখে প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করছে হাইকমিশন, এমনটিই জানালেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার।

তিনি বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের মেধা, শ্রম ও দক্ষতা মালয়েশিয়াসহ বিশ্বে প্রশংসিত। এ ধারা অব্যাহত রাখতে আমরা সচেষ্ট। বাংলাদেশ সরকার করোনাকালে প্রবাসেও কর্মীদের সহযোগিতা করেছে। একইসঙ্গে প্রবাসীরা দেশ ও নিজ দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এছাড়া করোনাকালে সম্মুখসারির কর্মী হিসেবে বাংলাদেশিরা মালয়েশিয়ায় কাজ করছে, যা এখনও চলমান।

করোনাকালে মালিক পরিবর্তন করার সুযোগ করে দিয়েছে হাইকমিশন এবং সফল হয়েছে। সংক্রমণের মাঝে কয়েক হাজার কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দূতাবাস। ‘আমরা মালিক পরিবর্তন করার সুযোগ করে দিয়েছি এবং সফল হয়েছি’। করোনা সংক্রমণের মধ্যে আমরা (দূতাবাস) কয়েক হাজার কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। বেতনহীন কর্মী যেন ছাঁটাই না করে।

হাইকমিশনার বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে করোনার মধ্যে দেশে ফেরত গেলেও মালয়েশিয়া থেকে একজনকেও কাজ হারিয়ে দেশে যেতে হয়নি। মালয়েশিয়ায় কর্মরত প্রত্যেক কর্মীকে বিমার আওতায় আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশটির সোশ্যাল সিকিউরিটি অর্গানাইজেশনের (সকসো) মেম্বারশিপ লাভ করেছেন ৫ লাখ ৬ হাজার ১৬৩ জন বাংলাদেশিকর্মী। এরই মধ্যে ১৩ কোটি ১২ লাখ টাকার বিমা আদায় করা হয়েছে। এ পর্যন্ত অস্থায়ী অক্ষমতাবরণকারী তিন হাজার ১৭৮ জনকে ৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা, স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণকারী ৬৮ জনকে ৪ কোটি ২১ লাখ টাকা, ২১৯টি মরদেহ পাঠানো বাবদ ২ কোটি ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। মার্চ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত ৮৫০ জনকে ৯৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকার সমপরিমাণ অর্থ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া পাবনার দেলোয়ার মোল্লা দেশে থেকে দুর্ঘটনাজনিত সুবিধা পাচ্ছেন। তিনি এককালীন ৭ লাখ ৭ হাজার টাকা পেয়েছেন এবং আজীবন তিনি ৬৫০ রিঙ্গিত করে পাবেন। এছাড়াও সিরাজগঞ্জের প্রামাণিক ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।

গত এক বছরে এক হাজার ৩০২ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন ৮০২ জন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৫০০ জন। এর মধ্যে দূতাবাসের পক্ষ থেকে সরকারি খরচে কয়েকটি মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে। গত এক বছরে হাইকমিশন থেকে ৮ হাজার ৩৯১টি সাধারণ ট্রাভেল পাস এবং ক্যাম্পে থাকা এক হাজার ৭৮৬ জনকে ট্রাভেল পাস দেওয়া হয়েছে বলেও মিশন সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে দেশটিতে বসবাসরত অবৈধ বিদেশি কর্মীদের বৈধকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে বছরজুড়ে ছিল আলোচনা। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে শর্তসাপেক্ষে শুরু হওয়া অবৈধদের বৈধকরণ প্রক্রিয়ায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি আবেদন করেছেন বৈধ হতে। ৩১ ডিসেম্বর শেষ হচ্ছে এ প্রক্রিয়া।

এদিকে বৈধতার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর জন্য কূটনৈতিকপত্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দফতরে অফিসিয়াল অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার।

গত ২০ ডিসেম্বর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজাহ জায়নুদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও বৈধতার মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করেন।

ওই সময় মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একজন বিদেশি কর্মীকেও যেন অনিয়মিতভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করতে না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। মালয়েশিয়ায় অনিয়মিতভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়মিতকরণ ও তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান ব্যবস্থার লক্ষ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এক গবেষণায় দেখা যায়, অন্যান্য দেশের শ্রমিকের তুলনায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের পারিশ্রমিক খুবই কম। কিন্তু বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় সবচেয়ে বেশি ও অনেক ক্ষেত্রে তারা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

মালয়েশিয়া প্রবাসী কামরুল বলেন, একজন অভিবাসী ইচ্ছে করে অবৈধ হয় না। দালালচক্র ইচ্ছে করে তাকে অবৈধ করে। বৈধ করে দেওয়ার নামে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও আট থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। তখন এই শ্রমিকের আর কিছু করার থাকে না।

প্রবাসীরা বলছেন, সরকারকে শ্রম মাইগ্রেশন খরচ সস্তায় সীমাবদ্ধতার মধ্যে আনতে, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে, অভিবাসন সমস্যা ও পুনর্গঠন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

এদিকে তিন বছরেরও বেশি সময় বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। নতুন বছরের শুরুতে বাজার উন্মুক্ত করতে মালয়েশিয়ার দুই মন্ত্রী বাংলাদেশে সফরে আসছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

স্বাক্ষর পরবর্তী প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের সংবাদ সম্মেলন সূত্রে ১৯ ডিসেম্বর জানা গেছে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার কর্মীদের অধিকার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মর্যাদাবান করে তোলার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

অভিবাসন ব্যয় এবার অতিরিক্ত হবে না এমনটাই বলা হয়েছে। কর্মীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাদি নিশ্চিত করা হয়েছে, মালয়েশিয়া যাওয়ার বিমান ভাড়া ও চুক্তি শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসার বিমান ভাড়া মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা/কোম্পানি বহন করবে।মালয়েশিয়ায় আসার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ, ভিসা ফি, ইমিগ্রেশন ফি, করোনা পরীক্ষার খরচ, কোয়ারেন্টাইনের খরচ ইত্যাদিসহ মালয়েশিয়া প্রান্তে সকল অভিবাসন ব্যয় মালয়েশিয়ার কোম্পানি বহন করবে।

মালয়েশিয়ায় কর্মীর মানসম্মত বাসস্থান ও আনুষঙ্গিক উপকরণ নিয়োগকর্তা ফ্রি দেবে। কর্মীর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিমার খরচ কোম্পানি বহন করবে। সপ্তাহে একদিন ছুটি (বিশ্রামের দিন) এবং দৈনিক ৮ ঘণ্টা বেশি কাজ করলে ওভারটাইম পাবেন। বিশ্রামের দিন ও পাবলিক ছুটির দিনে কাজের জন্য মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী আলাদা বেতন পাবেন।

বেতন-ভাতা কর্মীর নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে দেওয়া হবে। নগদ বেতন দিতে পারবে না। মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশি কর্মীরা বার্ষিক ছুটি ও অসুস্থতা ছুটি (মেডিকেল লিভ) পাবেন।

কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা কর্মপরিবেশের কারণে কোনো অঙ্গ অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাবে এবং স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশে ফেরত গেলেও কর্মী আজীবন পেনশন পাবেন। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারণে বা কর্ম পরিবেশের কারণে মারা গেলে মরদেহ দেশে পরিবহন খরচসহ কর্মীর পরিবার এককালীন ক্ষতিপূরণ ও স্ত্রী-সন্তানরা দীর্ঘমেয়াদি পেনশন পাবেন। এসব সুবিধা বাংলাদেশে বসেই পাওয়া যাবে।

ওপরের সুবিধা পাওয়ার যাবে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে নিয়োগ চুক্তি সই করলে। এ নিয়োগ চুক্তি সমঝোতা স্মারকের অংশ, তাই কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত।

বাংলাভিশনের অভিবাসন বিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক গাজী মেরাজ হোসেন বলেন, প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিতের ফলে প্রবাসে কর্মীর অবস্থান সুখের ও মর্যাদার হবে। দেশে পরিবার ভালো থাকবে।

এটিএন বাংলার কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর কেরামত উল্লাহ বিপ্লব বলেন, প্রবাসী কর্মীর অবৈধ হওয়ার অন্যতম কারণ কর্মস্থলের সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া এবং প্রতারণার শিকার হওয়া। সমঝোতা স্মারকে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে যা বাস্তবায়ন করতে পারলে যুগান্তকারী হবে।

অভিবাসনের সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি উন্মুক্ত করা হয়নি। যেখানে কর্মী, উভয় দেশের সরকার, নিয়োগ কর্তা, মালয়েশিয়ান ও বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সির দায় দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। এগুলো অভিবাসন প্রত্যাশী ও তাদের পরিবারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। এভাবেই অভিবাসনের অনিয়ম দূর করা সম্ভব হবে। সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আশা করি।

২০২২ সাল মালয়েশিয়া প্রবাসীদের জন্য অপার সম্ভাবনাময় একটি বছর। ২০২১ সালকে নিয়ে করা হিসাবের যোগ-বিয়োগের বাস্তব ফল যাই হোক তবে এটি সত্য যে, অবৈধদের জন্য মালয়েশিয়ায় বসবাসের সুযোগ দিনে দিনে শুধু সংকুচিত হবে।

ওএফ