২০২২ সালের শুরুতে সরকার প্রবাসে কাজে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য বিদেশ থেকে দেশে অর্থ প্রেরণে প্রণোদনার পরিমাণ ২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২.৫ শতাংশ করেছে। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট স্মারক পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জনমানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের গুরুত্ব বিবেচনায় বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত বৈদেশিক আয় বৈধ উপায়ে দেশে প্রত্যাবাসন উৎসাহিত করার লক্ষ্যে রেমিট্যান্স প্রেরণের বিপরীতে সরকার কর্তৃক ২ শতাংশ প্রণোদনা/নগদ সহায়তা প্রদানের বিদ্যমান হার বাড়িয়ে ২.৫ শতাংশে নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বর্ধিত এ হার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।’ 

এর সঙ্গে সরকার বৈধ উপায়ে দেশে অর্থ প্রেরণের জন্য উৎসাহিত করার ও অবদানের স্বীকৃতি প্রকাশ করেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত রেমিট্যান্স। এর বৃহৎ অংশে রয়েছে প্রবাসে শ্রমজীবী মানুষের আয়, যা কিনা পুরোটা বাংলাদেশে থাকা  পরিবারের নিকট প্রেরণ করে। নিজের নয় পরিবারের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনার সঙ্গে রয়েছে প্রচণ্ড রকমের আবেগ। তাই দেখা মেলে ১৫/২০ বছর থেকে দেশে না যাওয়া টাকার মেশিন প্রবাসীর!

প্রবাসী আয় যে প্রধান ৩০টি দেশ থেকে আসে তার মধ্যে মালয়েশিয়া পঞ্চম স্থানে। মালয়েশিয়া থেকে বৈধপথে ২০২০-২১ অর্থ বছরে দেশে এসেছে ২ হাজার ২ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে চলমান প্রাণঘাতী করোনায় সপ্তম স্থানে নেমে এসেছে মালয়েশিয়া।  গত অর্থ বছরে গড়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের তুলনায় ৪৭ শতাংশ কমেছে। 

বৈধ পথে দেশে অর্থ প্রেরণের খতিয়ান রাখেন রেমিট্যান্স হাউজগুলো। রেমিট্যান্স হাউজগুলোও প্রণোদনা দিয়ে তাদের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তবে সকল প্রবাসীর পক্ষে রেমিট্যান্স হাউজে পৌঁছা সম্ভব হয় না। সহজ প্রাপ্য ও সহজ পদ্ধতি না হলে গ্রাহক উৎসাহী হয় না। তবে নির্ভরশীল হিসেব রেমিট্যান্স হাউজের বিকল্প নেই। 

বাংলাদেশের অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ায় অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউজ এসডি এন বিএইচডির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিচালক খালেদ মোর্শেদ রিজভী বলেন, করোনার কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রায় ৪৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। করোনায় আয়ের ওপর যে আঘাত এসেছে সেটা কাটিয়ে উঠতে মালয়েশিয়া সরকার রিকভারি প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে ফলে ক্রমশ কর্মচঞ্চল হচ্ছে ও রেমিট্যান্স খাত চাঙ্গা হচ্ছে।

রেমিট্যান্সের বিপর্যয় পুষিয়ে নেওয়ার আশা প্রকাশ করে তিনি দেশে অর্থ প্রেরণ করতে এবং রেমিট্যান্সের ২.৫ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা নিতে অনুরোধ করেছেন।

প্রবাসীরা আয়ের অংশ দেশে পরিবারের নিকট পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অর্থ প্রবাহ সচল রাখছেন। কিন্তু তাদের আয়ের অর্থের আয়বর্ধক বিনিয়োগ হয় না। পরিবারগুলো কোনো উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ যেমন করে না তেমনি অর্থ প্রেরণকারী প্রবাসীর জন্য অর্থ সঞ্চয় করে না। 

বিশিষ্টজনরা বলছেন, এ পর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, প্রবাসীরা দেশে যে টাকা পাঠান তার বড় একটি অংশ ভোগ বিলাসেই ব্যয় হয়। আর বিনিয়োগ বলতে যা হয়, তা হলো জমিজমা কেনা, ঘরবাড়ি বানানো ও ফ্ল্যাট কেনা। প্রবাসী আয়ে এমন কোনো বিনিয়োগ হয় না যার মাধ্যমে আয় এবং কর্মসংস্থান হয়।

মালয়েশিয়া প্রবাসী কামরুল হক জানান, প্রবাসীরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি তৈরি করেন। কিন্তু সেই বাড়িতে তাদের কেউ থাকেন না। আবার প্রবাসীরা যে টাকা পাঠান তা দিয়ে তাদের স্বজনেরা জমি কেনেন। এর বাইরে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা, বিলাসিতা ও নানা ধরনের পণ্য ও সেবা কিনতে তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রবাসী আয় খরচ করেন। কিন্তু তাদের সন্তানরা যে সবাই ভালো শিক্ষিত হন তাও নয়। কারণ তারা দেশের বাইরে থাকায় তাদের সন্তানদের দেখাশোনার তেমন কেউ থাকে না।

ফলে প্রবাসীরা ২০-২৫ বছর পর দেশে ফিরে নিজের সম্পদ বলে কিছু পায় না। তারই অর্থে কেনা সম্পত্তিতে তার কোনো মালিকানা থাকে না। এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে সমস্যা হয়। অর্থাৎ তিনি যাকে বা যাদেরকে বিশ্বাস করে অর্থের সঠিক বিনিয়োগের দায়িত্ব দেন বা বিশ্বাস করেন তারাই প্রতারণা করে। 

মালয়েশিয়ার সেলাংগরের প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা ও হিসাববিজ্ঞান অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ও ইসলামি ক্ষুদ্রঋণ গবেষক ড. আবুল বাশার ভূঁইয়া বলেন, করোনার মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে সক্ষম রেখেছে।  যারা বিদেশে আসেন তাদের মধ্যে কিছু মানুষের প্রথম কয়েক বছর যায় ধারের টাকা শোধ করতে। তারপর দেশে থাকা পরিবারের খরচ মেটাতেই বাকি টাকা চলে যায়। বিষয়টি অমানবিক পর্যায়ে চলে যায় তাই প্রবাসীর অর্থ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ইয়ুথ হাবের সভাপতি পাভেল সারওয়ার বলেন, প্রবাসী আয়ের বিনিয়োগ হওয়া উচিত। সেটা হলে দেশে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এজন্যই প্রবাসীরা এখন সরাসরি বন্ড কেনার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এই স্থায়ী আমানতও এক ধরনের বিনিয়োগ। আর তাদের কিন্তু আয়ের ওপর প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের। কিন্তু তারা জমিজমা কেনা আর ঘরবাড়ি বানানো ছাড়া অন্য কোনো বিনিয়োগের কথা ভাবতে পারেন না। সে ধরনের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান বা উপস্থাপনা তাদের সামনে নেই।

পাভেল সারওয়ার মনে করেন, এজন্য প্রবাসীদের জন্য আলাদা ইকোনমিক জোন করা দরকার। বিনিয়োগের নিরাপত্তা পেলে হয় তো তারা বিনিয়োগ করবেন। 

এই দুই বিশ্লেষক মনে করেন,  ভোগ-বিলাসে অর্থ ব্যয় হওয়ার পর তাদের হাতে কিছু থাকে না। আবারও ছুটতে হয় প্রবাসে।

মালয়েশিয়া প্রবাসী ব্যবসায়ী ড. আরিফ বলেন, প্রবাসীরা তো সাধারণ মানুষ। তাই তারা প্রচলিত বিনিয়োগ করতে সাহস পায় না, পুঁজি হারান।

অনেকেই বলছেন, ভোগে নয়, শুধু দিয়েই যায় প্রবাসীরা। একজন প্রবাসী যা আয় করে দেশেই পাঠিয়ে দেয়। সুবিধা পায় পরিবার। এমন কী প্রবাসী কর্মী মারা গেলে সরকারি প্রদত্ত অর্থ পরিবারই পায়, প্রবাসী ভোগ করতে পারে না, শুধু দিয়েই যায়! এবার মহামারি করোনায় দেশে ফেরত বা আটকে পড়া প্রবাসীদের প্রতি পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের নির্মম নির্দয় আচরণ প্রমাণ করেছে প্রবাসী যেন টাকা আয়ের মেশিন মাত্র, আবেগ অনুভূতি প্রাপ্তি প্রত্যাশা কিছুই থাকতে নেই! প্রবাসীর প্রতি পরিবারগুলোর দায়বদ্ধতা ও আয়ের সঠিক ব্যবহার সুনির্দিষ্ট নীতি ও পদ্ধতির আওতায় আনা গেলে প্রবাসী দেশে ফিরলে যে সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষা পাবে, তা আরেক রকম প্রণোদনা হিসেবে চিহ্নিত হবে।

ওএফ